মালদ্বীপে যা দেখলাম
- ইয়াসমিন হোসেন
সবকিছু ছবির মতো। সু-শৃঙ্খল। মানুষজনের চলাফেরা ছন্দপতনহীন। গাড়িগুলো চলে ধীরে-সুস্তে, একাগ্র চিত্তে। কোন বেপরোয়াপনা নেই। দোকানপাট, অফিস-প্রতিষ্ঠান যেন এক-একটি আইকন। নির্ঝঞ্জাট আর ঝকঝকে-তকতকে। এগুলোর কাঁচের দেওয়ালগুলো এতোটাই স্বচ্ছ যে তার অস্তিত্ব আছে কি নেই- বোঝা কঠিন। পণ্যের সঙ্গে দাম লেখা আছে (সে ফল-মূল, আলু, তরকারি যাই-ই হোক না কেন), কোন দামাদামির কারবার নেই। দাম দিয়ে কিনে নিতে হবে। রাস্তাঘাট খুবই পরিচ্ছন্ন। ময়লা নেই। পুরো মসৃন আর দীপ্তিময়। দূরে দূরে জেব্রাক্রসিং। সেখান দিয়েই মানুষ রাস্তা পারাপার হন। অন্য কোথা দিয়ে কেউ পারাপারের চেষ্টাও করেন না।
ফুটপাত থেকে জেব্রাক্রসিংয়ে পা রাখার সঙ্গে থেমে দাঁড়ায় আসা-যাওয়ার গাড়ি। ক্রসিং পেরিয়ে আরেক পাশের ফুটপাতে পা না দেওয়া পর্যন্ত এগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নজরদারির জন্য কোথাও ট্রাফিক নেই। পুলিশও নেই। তাঁদের দরকারই হয় না। কারণ নিয়ম শৃঙ্খলাগুলো সবাই নিজে থেকেই মেনে চলেন। এটা তাঁদের মগজে ধারণ করা। আবার, মূলবান জিনিসপত্রে ভর্তি কাঁচের দোকানগুলো রাতের বেলা বন্ধ থাকে ছোট্ট একটা তালায়, ঠিক টিপতালার মতো। কোথাও কোন পাহারা থাকে না। তারপরেও কোন চুরি তো হয়ই না, সামান্য অঘটনও ঘটে না। দেশটিতে নাকি চোরই নেই।
এটা এমন একটা দেশ- যেখানে কেউ অন্যায় করে না, দুর্নীতি করে না। কেই কাউকে ঠকায় না, প্রতারণা করে না, খাদ্যে ভেজালও দেয় না। কেউ মিথ্যা বা শঠতার আশ্রয় নেয় না (সমুদ্রের বোট ভাড়ার সময় দাম-দরটা করে ফয়সালা করে নেয়)। কারও কোন ক্ষতি বা কষ্ট হয়- এমন কোন কাজ তাঁরা করেন না। কারণ এখানে মানুষের অভাব নেই। সবমিলে তাই দ্বীপটা জলজ্যান্ত বেহেস্ত!
এই হলো মালদ্বীপ। মুসলিম দেশ। এ কারণে দিনের বেলা নামাজের সময় দোকানপাট ওই সময়টুকুর জন্য ছোট্ট টিপ তালা দিয়ে বন্ধ রাখা হয়। কাঁচের ভেতর লেখা থাকে ক্লোজড। তবে অন্য সবকিছু খোলা বা স্বাভাবিক থাকে। এখানে মেয়েরা বোরখা পড়ে না। পড়ে শুধু কালো হিজাব, জিন্স প্যান্ট আর কালো বা নীল গেঞ্জি। এই পোশাকেই তারা সব কাজ করেন। মটর বাইক চালানো থেকে কর্মস্থলে কাজ করা- সবই।
এখানে মটর বাইক চালানোয় নারী-পুরুষ সমানে সমান। বাইকগুলো চলে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে, নিয়ম মেনে। আমাদের দেশের মত এখানে বেপরোয়া চালানোর মত বাইকও ব্যবহার হয় না। সবাই ব্যবহার করেন ভ্যাসপা জাতীয় বাইক। দেশটিতে নারী-পুরুষ সবাই কাজ করেন। কোন বেকারত্ব নেই। দোকানদারী, শ্রমিকের কাজ থেকে তাবৎ কিছু নারী-পুরুষরা নির্বিঘেœ করেন। মুসলিম দেশ হলেও এখানে কোন ধর্মান্ধতা বা কুসংস্কার নেই। জীবনযাত্রা চলে উন্নত বিশ্বের ধাঁচে।
এখানে সবকিছুর দাম আকাশচুম্বি। বাড়ি-ঘর-দোকান-পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আধুনিক, উন্নত বিশ্বের মত। সবার আয়-রোজগারও উঁচু মানের। শুধুমাত্র পর্যটন ব্যবসা আর মাছ বিক্রি করে এতো উন্নত অবস্থা। ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়! পুরো দেশটি ডিজিটালাইজড। ঠিক সিঙ্গাপুরের মত। গেলবার সিঙ্গাপুর ভ্রমণে গিয়ে যেমনটা দেখেছিলাম, এখানকার সবকিছু তেমনই সু-শৃঙ্খল ছকে বাধা।
কার্যত কিন্তু আহামরি বিত্ত্বশালী দেশ নয় মালদ্বীপ। এটা এই কারণে যে, তাদের নিজস্ব কোন উৎপাদন নেই। পর্যটন ব্যবসা আর সমূদ্রের মাছ বিক্রি ছাড়া আয়ের কোন উৎস নেই। জমি নেই, ফসল নেই। তাই জীবন-যাপনের তাবৎ কিছু অন্য দেশ থেকে কিনে আনতে হয়। এমনকি পানি পর্যন্ত আমদানি করে খেতে হয়। পর্যটন ব্যবসা না থাকলে এদেশের অস্তিত্বই থাকার কথা নয়।
দেশটির সম্পদ সমুদ্র। এই সম্পদকেই কাজে লাগিয়েছে মালদ্বীপ। সমুদ্রকে ব্যাপক আয়ের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। অর্থাৎ সমুদ্রকে বিদেশিদের বেড়ানোর উপযোগী করে সাজানো হয়েছে। যে কারণেই না, বিদেশে থেকে পর্যটকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এই দেশটিতে। আর তাদের বদৌলতে দিব্বি গোটা দেশ রাজারহালে চলতে পারছে।
দেশটির চারদিকে শুধুই সমূদ্র। তার মাঝে ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপ। এরকম দ্বীপ সংখ্যা এক হাজার তিনশ মত। দ্বীপমালার দেশ বলেই নাম হয়েছে মালদ্বীপ, মানে- দ্বীপের মালা। হাতে গোনা কতগুলো দ্বীপে জনবসতি রয়েছে। অনেকগুলো এখনও বসবাসের অনুপোযোগী। বাসযোগ্য দ্বীপের ভেতর আবার বেশিরভাগই শুধুমাত্র পর্যটকদের বেড়ানোর জন্য সাজানো। শহর দ্বীপ বলতে রাজধানী মালে, আর তার পাশেই হুলুমালে। যতটুটু জেনেছি, এই দুটোই মূলত শহুরে ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা।
মালদ্বীপ থেকে শিক্ষা এটিই যে, ওরা একেবারে স্বল্প জনবল দিয়ে এবং একটা-দুইটা সম্পদ দিয়েই রাজকীয়। এই সম্পদে দেশ চলে, রাষ্ট্র চলে। কিন্তু আমরা বা আমাদের দেশ বিশাল জনবল আর অফুরন্ত সম্পদের অধিকারী হয়েও অনেক অনেক পিছিয়ে। সব থাকতেও আমরা আহামরি কিছু করতে পারিনি। ধারণা এটাই মিলেছে যে, ওরা পেরেছে, কারণ ওরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার তাগিদ অনুভব করেছে, এবং তারজন্য ভেবেছে ও কাজ করেছে। তাই ওরা সফল। আমরা ভাবিও না, করিও না। সমুদ্র, নদ-নদী, খাল-বিল কী না আছে আমাদের! কিন্তু সব ভাবনা-চিন্তার অভাবে মরে আছে। আমাদের সব জনবল তাই বোঝা। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আজ কিন্তু জরুরিভাবে ভাবা দরকার।