আধুনিক দেশ মালয়েশিয়া
- ইয়াসমিন হোসেন
তখন করানাকাল ছিল না। এরকম একটা সময়ে ব্যাংককের ডংমং (ডিএমকে) এয়ারপোর্ট। ভোর ৬টার দিকে পা রাখলাম। দিনটি ছিল ২ অক্টোবর। তখনও অন্ধকার কাটেনি। ট্যাক্সিকে বিদায় দিয়ে লবিতে ঢুকলাম। এদিক-ওদিক জিজ্ঞেস করে কাউন্টারের খোঁজ নিলাম। হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। পুরো আড়াই ঘণ্টারও বেশি।
একেকটা লবি বিশাল বিশাল। একটা থেকে আরেকটার দূরত্বও কম নয়। আমরা বেশ ধীরেসুস্থে কাজ সারছিলাম। আমরা মানে আমি আর আমার স্বামী। সকালের নাস্তা হয়নি। ভাবলাম বিমানে নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট মিলবে। আপাততঃ হালকা কিছু খেয়ে নিলেই হলো। থাই এয়ারপোর্টে খাবার জিনিস সঙ্গে নিতে দেয়না বলে কিছু আনা হয়নি। সামনে এগুতেই অনেক ফাস্টফুডের স্টল মিললো। সেখান থেকে বিস্কুট আর পানির বোতল কিনে রাখলাম। তারপর একেবারে শেষ মাথায় আমাদের লবিতে চলে গেলাম।
এরমধ্যে কাউন্টার খোলার পর এয়ার এশিয়ার বোর্ডিং পাস নিয়ে (টিকেট কেটে) লাগেজ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের ফ্লাইট নম্বর ছিল একে ৮৯১ কেইউএল। বোর্ডিং টাইম ছিল ৭টা ৫৫। গেট নম্বর ২৫। আর সিট নম্বর ছিল ২৪ এ এবং বি। আমাদেরকে টানা দুই ঘণ্টা বসে কাটাতে হলো। শেষে বিমানে ওঠা।
মালয়েশিয়ার এয়ার এশিয়া আমাদের রিজেন্ট এয়ারের চেয়ে মোটেও ভাল মানের নয়। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো- এরা বিমানে কোনো খাবার দেয় না। খাবার আছে, তবে তা কিনে খেতে হয়। অথচ ঢাকা থেকে ব্যাংকক যাবার সময় রিজেন্ট এয়ারে দুই দফা খেতে দিয়েছিল। তাই কিনে খাওয়ার চিন্তা বাদ দিলাম। যেহেতু ১১টা ৫০ মিনিটে এটা কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে (কেএলআইএ) ল্যান্ড করবে, সেহেতু নাস্তা করাটা তেমন জরুরি নয়। তাছাড়া বিস্কুট দিয়ে হাল্কা নাস্তা তো করাই আছে।
ইমিগ্রেশন ব্যুরোর ডিপারেচার কার্ড পূরণ করে রেখে দিলাম। যথা সময়ে কেএলআইএতে ল্যান্ড করলো বিমান। ইমিগ্রেশনে ব্যাংককের মতোই কোনো ঝামেলা হলো না। নির্বিঘেœ লাউঞ্জে চলে এলাম। প্রথমেই কাউন্টার থেকে ডলার ভাঙ্গিয়ে মোবাইলে নতুন সিম লোড করলাম। তারপর ভাবলাম ব্যাংককের মতোই বোধহয় এখানেও গলায় নামলেখা ঝোলানে গাড়ির ড্রাইভার দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু না, এখানে সে ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে কন্ট্রাক্ট পারসন সাথিয়ানকে ফোন করলাম। ওপার থেকে ইংরেজিতে জানালো, সে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে, সবুজ রংয়ের গাড়ি। আমরা ৩ নম্বর গেট দিয়ে বেরুতেই তাঁকে পেলাম। তাঁর পুরো নাম সাথিয়াসলান মুথু (Sathiyaseelan Muthu)। তামিল। জন্মস্থান তামিলনাড়ু। কথায় কথায় জানতে পারলাম উচ্চ শিক্ষিত তিনি। কুয়ালামপুরই তাঁর স্থায়ী আবাসস্থল। দুই শিশু সন্তান নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সংসার। মুথু বেশ কতগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারপরেও গাড়ি চালান। তিনি সিটি ফ্লাইয়ার্স হলিডেজ এসডিএন বিএইচডির ডিরেক্টরও। গাড়িটি তাঁরই প্রতিষ্ঠানের। বাংলাদেশের একটি ট্যুর এজেন্সির সঙ্গে তাঁর পার্টনারশিপ রয়েছে।
আমরা বেশ লম্বা পথ পারি দিচ্ছিলাম। দু’ধারের দৃশ্য ঠিক আমাদের দেশের মতোই। মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে রাজধানী ঢাকার পথে চলেছি। বাড়িঘর, গাছাপালা সবই দেশের মতো। মূল নগরীর কাছাকাছি আসতেই অবশ্য নিরিবিলি পরিবেশ কমতে লাগলো। বাড়িঘর, ভবন বেশি চোখে পড়লো।
প্রথমেই আমরা মিথুকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলাম। এটা ছিল বুকিৎ বিনতাংয়ে মাই হোটেল। ছবির মতো সাজানো গোছানো নগরীর ভেতর দিয়ে চলছিলাম। রাস্তাঘাট, মার্কেট এবং ফ্লাইওভারগুলোতে অন্যরকম এক আভিজাত্য। যা আমাদের দেশে নেই। রাস্তাঘাটে আমাদের দেশের মতো এতো লোকজনও নেই। এখানেও মাটির নিচে পাতাল রেল, মাথার উপর ফ্লাইওভারগুলোতে মেট্রোরেল এবং রা স্তায় সুন্দর সুন্দর যানবাহন চলছে।
আমরা হোটেলে যখন পৌঁছালাম তখন ভর দুপুর। মুথুকে বিদায় করে বুক করা রুমের চিপস কার্ড নিয়ে নিলাম। রুম ছিল দ্বিতীয় তলায়। চমৎকার। আমাদের রুম সার্ভিসে পড়েছিল এক বাঙালি ছেলে। বেশ ভালই হলো। তারসঙ্গে কথা বলে দুপুরের খাবারের ঠিকানা জেনে নিলাম। এই হোটেলের পেছন দিকেই একটা বাঙালি হোটেল আছে। সিদ্ধান্ত নিলাম ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়বো।
মালয়েশিয় সময় অনুযায়ী প্রায় দুটো মতো বেজে গিয়েছিল। আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পাশের রাস্তায় ঢুকে হোটেলের পেছন দিকে উঁচুমত সড়ক পথে চলে এলাম। এদিকটা আবাসিক এলাকার মতো। উঁচু উঁচু ফ্লাট, মনে হলো বেশিরভাগই বাসাবাড়ি। তবে বাণিজ্যিক ভবনও দেখা গেল। নিচতলায় বেশকিছু শপিং স্টোর, চাইনিজ হোটেল, মোটেল ইত্যাদি। এর পাশ দিয়ে গলিপথ চলে গেছে। আমরা এরকম বেশ কয়েকটি গলিপথ পেরিয়ে চাইনিজ মার্কেট এলাকায় ঢুকে পড়লাম। কিছুদূর এগুতেই চোখে পড়লো বাংলায় লেখা- রসনা বিলাস। তাতে আরও লেখা, মালয়েশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট। দেখলাম হোটেলের প্রায় সব খরিদ্দারই বাঙালি। তারমানে এই এলাকায় বহু বাঙালি বসবাস করে।
হোটেলে ঢুকে খাবারের দাম শুনে অবাক হলাম। কারণ পুরো একপ্লেট মাংসের দাম দুই রিঙ্গিত। মাছ, মাংস, ভাত, তরিতরকারি পেটপুরে দুজন খাওয়ার পর বিল এলো ১৭ রিঙ্গিত। এই রিঙ্গিতকে আমরা বাংলাদেশি টাকার হিসেবে ভাবছিলাম। বাংলাদেশে দু’জন মিলে এতো ভাল ভাল খাবার পেট পুরে খেয়ে ১৭ টাকা বিল হবে না। নিশ্চয় তা হবে কমপক্ষে ৪/৫শ টাকা। তবে হিসেব করে দেখলাম এক রিঙ্গিত সমান বাংলাদেশি ২০ টাকা হলে এই ১৭ রিঙ্গিতে হচ্ছে ৩৪০ টাকা। সেদিক থেকে ঠিকই আছে। বরং বাংলাদেশের চেয়ে এখানে দাম খানিকটা কমই মনে হলো। তারপরেও ১৭ রিঙ্গিত শুনে ১৭ টাকাই মনে গেঁথে থাকছিল। ফলে বেশ মজা এবং হতচকিত ভাব থেকেই গেছে।
প্রথম দফায়ই হোটেলের ম্যানেজার এবং কর্মচারিদের সঙ্গে বেশ ভাব জমে গেল। বিদেশে দেশি মানুষ পেলে বোধহয় এমনই হয়। আমাদেরও তাই হলো। তাদের কাছ থেকেই জেনে নিলাম ডলার ভাঙানোর স্থান। এরপর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নেওয়ায় মনোযোগ দিলাম। ঘণ্টা দুয়েক পর বের হয়ে নগর দেখবো। পরদিন সাইড সিয়িংয়ের জন্য সকাল ১০টায় মুথুর আসার কথা।
বিকেলে বেড়ানো : হোটেলে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাজানো গোছানো রাজপথের ধারে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কোন্ দিকে যাবো। রাস্তা, ফুটপাত, গাড়ি-বাড়ি সবই চমৎকার। কোথাও কোনো নোংরা নেই। বাড়িঘরে রংচটা ভাব নেই। সব ঝকঝকে। শুনেছিলাম, এটা মুসলিম দেশ। ধর্মীয় দিক থেকে তাই হয়তো মৌলবাদী হবে ভেবেছিলাম। কে যেন বলেছিল, আজান পড়লেই সবাইকে সৌদি আরবের মতো বাধ্যতামূলকভাবে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। কিন্তু কোথাও এর সত্যতা দেখছিলাম না। বরং ব্যাংককে যে রকম লেংটি আর অর্ধনগ্ন পোশাক পরে মেয়েদের চলতে দেখেছি, এখানেও তাই-ই দেখছি। অনেক নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী অর্ধনগ্ন ড্রেসে রাস্তায় চলছেন। কেও তাকিয়েও দেখছেন না। আমাদের দেশের মতো নাক সিটকানো তো দূরের কথা। তবে চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিলো ঘুরে বেড়ানো সবাই বিদেশি। দেশি মেয়েদের দেখলাম হিজাব পড়ে চলছে। দেশি-বিদেশি বোঝা যায় চোহারা দেখে। বিদেশিরা সাদা চামড়ার, আর দেশিরা আমাদের দেশের চাইতেও কালো চামড়ার।
আমরা নামাজ পরার কোনো ঘটনাই দেখলাম না। আজানের শব্দও শুনতে পাইনি। সেটা নাকি মসজিদ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশের মতো সারা এলাকা মাতিয়ে এটা প্রচার করা হয় না। খুব ভাল লাগলো এ ব্যবস্থা দেখে।
আমরা দুজন এদিক ওদিক তাকিয়ে হোটেলের সামনে থেকে ডান দিকের পথ ধরলাম। কারণ সবই শহর, একই রকম দৃশ্য। ফুটপাতে যখন পা চালাচ্ছিলাম তখন ভাল লাগছিল ছিমছাম পরিবেশ দেখে। লোকজন কম। স্থানীয়দের সংখ্যা নেই বললেই চলে। যারা চলাচল করছেন প্রায় সবাই বিদেশি। বিদেশি পোশাকেই তারা নির্বিঘেœ ঘুরছেন। ভাবছিলাম, জঙ্গিবাদী-মৌলবাদী দেশ হলে তো এমনটি হবার কথা নয়। আর এইসব বাদীরা থাকলে নিশ্চয়ই এদেশ এতো এগুতেও পারতো না, মানুষ নির্বিঘেœ চলতেও পারতো না। সবচেয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আধুনিক মালয়েশিয়া গড়ার কারিগর মহাথির মোহাম্মদের কথা। তিনি প্রথম ক্ষমতায় আসার আগে আমাদের দেশের চাইতেও জঘন্য, বিদ্ধস্ত, নোংরা এবং গরীব একটা দেশ ছিল মালয়েশিয়া। মহাথির ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৮১ সালে, আমাদের দেশে এরশাদও তখন ক্ষমতা দখল করেছিলেন। প্রায় এরশাদের সমান সময় ক্ষমতায় ছিলেন মহাথির। এই মেয়াদেই তিনি এক লাফে মালয়েশিয়াকে উন্নয়নের স্বর্গ বানিয়ে তুলেছেন। আর আমরা যা ছিলাম তাই-ই থেকে গেছি। যদিও মালয়েশিয়া গণতান্ত্রিক দেশ নয়। রাজতন্ত্র আজও বহাল। কিন্তু দেশের উন্নয়ন তো চমকে দিয়েছে। আজ মালয়েশিয়া মানে স্বর্গরাজ্য। মাথা ঘুরে যায় উন্নয়ন দেখে। আমরা যে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম- তা এতোটাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন যে এক ফোটা ময়লা ফেলতেও ইচ্ছে হয়না। যদিও ব্যাংককের মতো এখানেও কড়া আইন রয়েছে। এক ফোটা ময়লাও ফেলা যাবে না। ফেললে কম্পিউটারে ধরে ফেলবে পুলিশ। কারণ এ নগরীও ডিজিটালাইজড। সব যানবাহন চলে ল্যাপটপ আর কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে।
ফুটপাতের ধারে ড্রেনেজ সিস্টেম দেখলাম। সেই নর্দমার পানিও স্বচ্ছ, পরিস্কার। কোথাও ভিন্ন রং, ময়লা, শ্যাওলা- এসব কিছুই নেই। পরিস্কার নর্দমা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পানি। আর আমাদের দেশে! ভাবলে কান্না পায়। আমরা ফুটপাত ধরে যতোদূর এগুলাম, গোটাটা জুড়েই মাথার উপর চমৎকার ছাদ। মেঘ-বৃষ্টি-রোদের ভয় নেই। তা ছাড়া এদেশ এক ঋতুর দেশ, মেঘের দেশ। মুহূর্তে মুহূর্তে বৃষ্টি হয়। সে কারণেই বোধহয় সব ফুটপাতে ছাদ করা হয়েছে। মাথার উপর বিশাল বিশাল দালান-কোঠা ছাড়াও দেখছিলাম ফ্লাইওভার। যেগুলো দিয়ে চলছিল মেট্রোরেল। এই বিকেলেও রাস্তায় তেমন লোকজন না থাকার রহস্য বোধহয় এসব কারণেই। মানুষ একইসঙ্গে রাস্তায় যানবাহনে চলতে পারেন, একইসঙ্গে উপরে মেট্রোরেল দিয়ে যেতে পারেন, আবার একইসঙ্গে মাটির নিচের রেলপথ দয়ে চলতে পারেন। তাছাড়া আমাদের দেশের মতো এই দেশে লোকসংখ্যা তো বেশি নয়। তথ্য অনুযায়ী, কুয়ালালামপুর নগরীতে জনসংখ্যা মাত্র ১৭ লাখ। যেখানে ঢাকা নগরীতে সংখ্যা দুই কোটির মতো। সুতরাং একদিকে যাতায়াতের তিন পথ, আরেকদিকে জনসংখ্যা অনেক কম- সবমিলে চমৎকার পরিবেশ। আমাদের দেশে এর উল্টো অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেক দূর এগুলাম। শুধু বড় বড় দালানকোঠা, রাজপথে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন যানবাহন। সেগুলো যেখানে সেখানে থামছে না। শুধু রাস্তা পার হওয়ার সময় সিগন্যাল বাতির জন্য থামছে। সবুজ আলো না জ¦লা পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকছে। অথচ সামনে ফাঁকা রাস্তা। এই না হলে শৃঙ্খলা! মাথার উপর দিয়ে ঘনঘন মেট্রো ট্রেন যাচ্ছিল। এন্ড্রুয়েড মোবাইলে অ্যাপ খুলে দেখছিলাম মাটির নিচ দিয়েও অনবরত ট্রেন চলছে। ফুটপাতের উপর কোনো স্টল নেই। আছে যথাসম্ভব পাশে এবং দূরে। কিছু কিছু জায়গায় ফুটপাতের জায়গাটা বড় মাঠের মতো। সেখানে বসার জায়গা আছে। ওইসব জায়গায় আমাদের দেশের মতো পাগল ও ভিক্ষুক দেখতে পাচ্ছিলাম। পাগল টাইপের লোকরা সুটকেস বোঝাই কাপড় চোপড় নিয়ে ঠাঁয় বসে আছে। পোশাকি চেহারায় আমাদের দেশের মতো ময়লা ঘিনঘিনে। আর ভিক্ষুক কৌটো সামনে রেখে চুপচাপ বসে আছে। কারও কাছে কিছু চাইছে না। হয়তো চাওয়ার নিয়ম নেই। কোনো কোনো ভিক্ষুক শ্রেণীর লোককে পলিথিনে রাখা তরল মতো কিছু পাইপ দিয়ে পান করতে দেখলাম। কারও হাতে সফট ড্রিংকের বোতল। তার ভেতর কি আছে কে জানে! আমাদের দেশে হলে ফেন্সিডিল বা মাদক জাতীয় জিনিস থাকতো।
ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার ওপারে চলে গেলাম। একটা শপিং মল। মাইডিন। ভেতরে এলাহী কারবার। আমাদের দেশের বসুন্ধরা বা যমুনা ফিউচার পার্কের মতো প্রায়। কেনাকাটার সব রকম জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো বিশাল মার্কেট। জিনিসপত্র দেখছিলাম, আর ভিরমি খাচ্ছিলাম। কারণ ৪শ টাকার জিনিস যদি ২০ টাকা লেখা থাকে- তাহলে ভিরমি তো খাবারই কথা। আসলে ২০ টাকা নয়, ২০ রিঙ্গিত। আমরা একে টাকা বলেই মনে করছিলাম। কিন্তু এই ২০ টাকা বা রিঙ্গিতকে ২০ দিয়ে গুন করলে ঠিকই আমাদের দেশের ৪শ টাকা বেরিয়ে আসে। প্রথম দর্শনে অবশ্য ওইসব হিসাবের কথা মনে থাকে না। তাই এতো
সস্তায় বহুকিছু কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। টানা বেড়ানো : পরদিন টানা বেড়ানো। মুথু আমাদের নিয়ে গিয়েছিল কিংস প্যালেস, কেএল টাওয়ার, ন্যাশনাল মন্যুমেন্ট, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার (কেএলসিসি), ন্যাশনাল মসকসহ কয়েক জায়গায়। এছাড়া নগরীর বিভিন্নস্থান ঘুরিয়েছে। মুথুকে ছেড়ে দেওয়ার পর আমরা হানিফ্ফা মার্কেট, মাইডিনসহ বেশ কিছু জায়গায় ঘুরেছি। কিংস প্যালেস : সাইয়েদ পুত্রা সড়কের কিংস প্যালেসকে বলা হয় রয়াল প্যালেস। মুথু অবশ্য কিংস প্যালেস বলেই পরিচয় করিয়েছে। এটি এক সময় (১৯২৮ সালে) চীনা ধনক‚বেরদের আবাসস্থল ছিল। পরে জাপানিদের দখলে ছিল ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। জাপানিরা এটাকে অফিসার্স মেস হিসেবে ব্যবহার করতো। এরপর জাপানীরা আত্মসমর্পন করলে এটি সেলাঙ্গর রাজ্য সরকার কিনে নেয়। তখন থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এটি ছিল সেলাঙ্গর সুলতানের প্রাসাদ। পরে এটি মালয়েশিয় রাজার নিয়ন্ত্রণে আসে। এখনও সেরকম নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। প্রাসাদের চারদিক ঘেরাও করা। আমাদের দেখানোর জন্য প্রধান ফটকের সামনে নামানো হয়েছিল। আরও অনেক পর্যটক এখানে ভিড় করেছিলেন। সামনের দিকটা মনোরম। অনেকটা পাহাড়ি দৃশ্যের মতো। কারণ দূরের সবকিছু পাহাড়ের উপর বলেই মনে হচ্ছিল। প্রসাদের ফটক বন্ধ। সেখানে সশন্ত্র বাহিনীর লোকজন কড়া পাহারায়। ফটকে দুটি গার্ডপোস্ট। ঘোড়ার পিঠে রয়েছে তলোয়ারধারী গার্ড। জানা গেল, জনসাধারণের জন্য প্রসাদ খোলা হয় না। তবে ফটকের সামনের বিশাল লনে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ রয়েছে। সুযোগ রয়েছে গার্ডদের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলারও। আমরা বেশকিছু ছবি তুলে পরবর্তী গন্তব্যের জন্য প্রস্তুত হলাম। কেএল টাওয়ার : জালান পুনাক সড়কের পাশে কেএল টাওয়ার বা কুয়ালালামপুর টাওয়ার। এটার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১ অক্টোবরে। আর শেষ হয়েছিল ১৯৯৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে। জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই। এই কেএল টাওয়ারের উচ্চতা ৪২১ মিটার বা ১ হাজার ৩শ ৮১ ফুট। এতে ৮২ হাজার ৮শ ৮২ বর্গফুটের ৬টি ফ্লোর এবং ৪ দফা লিফটের ব্যবস্থা রয়েছে। টাওয়ারটি ইসলামী দর্শনের স্তম্ভ হিসেবে মনে করা হয়। আমরা লক্ষ্য করে দেখলাম টাওয়ারের একেবারে মাথার দিকে ফ্লোরের অবস্থান। নিচে থামের মতো, তার উপর ওই ফ্লোর। আবার ফ্লোরের মাথায় আমাদের দেশের মোবাইল টওয়ারের মতো বিশাল টাওয়ার। সত্যিই, অতো উপরে উঠে নিচে তাকিয়ে মানুষের কী অবস্থা হয় কে জানে!
এই টাওয়ার দেখতে অনেক পর্যটক আসছিলেন। দোতলা বাস টইটুম্বুর হয়েও আসছিলেন অনেক তরুণ-তরুণী। তবে সবাই বিদেশি। ন্যাশনাল মন্যুমেন্ট : এটি জালান পার্লিমেন সড়কের ধারে লেক গার্ডেনে অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে এটাকে উল্লেখ করা হয়েছে
Tugu Negara, Kuala Lumpur, 50480 Kuala Lumpur, Wilayah Persekutuan Kuala Lumpur, Malaysia
বলে। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। পাঁচটি প্রধান উপাদানকে নিয়ে স্থাপনাটির ৪৮ হাজার ৫৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্মৃতিস্তম্ভ প্যাভেলিয়ন। যাতে ঠিক আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই সামরিক পোশাক পড়া আধুনিক অস্ত্র হাতে কয়েকজন সেনাকে নিহত মানুষের উপর বিজয়ের পতাকা তুলে রাখতে দেখা যাচ্ছে। কালো পাথরের এই স্থাপনাকে একেবারে জলজ্যান্ত মনে হয়। এই মন্যুমেন্ট এলাকায় রয়েছে পাখিশালা, প্রজাপতিশালা, দর্শনীয় লেক, ফোয়ারা, গোলাপ ফুল ও অর্কিড গার্ডেন। প্রবেশপথে স্বেতপাথরের আরেকটি চমৎকার স্মৃতিতম্ভ আছে। যাতে লেখা আছে UNTOK MENGINGINGATI
JASA PAHLAWAN-PAHALAWAN YANG GUGOR / TO OUR GLORIOUS DEAD / 1914-1918,
1939-1945, 1948-1960.
অনেক পর্যটক এখানেও আসছেন। ঘুরছেন, ছবি তুলছেন। আমরাও বাদ গেলাম না। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার : মালয়েশিয়ার গর্ব। এটাকেই মালয়েশিয়ার নয়া উত্থানের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মোহাথির মোহাম্মদ আধুনিক মালয়েশিয়ার গর্ব হিসেবে এটাকে তৈরি করেছিলেন। এটি একশ একর বা ১৩ লাখ বর্গফুট ভ‚মির উপর স্থাপিত। সরকারি তথ্যানুযায়ী, ৮৮ তলার দুটি টাউয়ারের এক-একটির উচ্চতা প্রায় সাড়ে চারশ মিটার বা এক হাজার ৪৮৩ ফুট। এই টুইন টাওয়ারই মালয়েশিয়ার সিটি সেন্টার। দুটি টাওয়ারে রয়েছে আধুনিক সব শপিং মল, কনভেনশন সেন্টার, হোটেল, অফিস, প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদি। একটি টাওয়ার থেকে আরেকটি টাওয়ারে যাবার জন্য রয়েছে ওয়াকিং টানেল। পর্যটকদের জন্য গর্বের এই টাওয়ার দেখার সুযোগ রাখা হয়েছে টিকিটের বিনিময়ে। যেমন বয়স্কদের জন্য টিকেটের দাম ৮০ রিঙ্গিত এবং শিশুদের জন্য ৩০ রিঙ্গিত। সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত ভিজিটিং আওয়ার। আমরা যখন এই গর্ব দর্শনের জন্য গেলাম তখন বার বার মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল আকাশ। তাতে বরং সুবিধাই হয়েছিল। কারণ সূর্যটা এতোটাই টাওয়ারের মাথায় ছিল যে ক্যামেরা তাকই করা যাচ্ছিল না। মেঘে ঢাকতেই তাক করার সুযোগ তৈরি হচ্ছিল। আমরা সেই সুযোগে যতোটা সম্ভব ছবি তুললাম। অনেক পর্যটকই শুয়ে-বসে নানা কায়দায় ছবি নিচ্ছিলেন। আমাদের ভেতরে ঘোরার মতো সময় ছিল না। কারণ ওভাবে ঘুরতে হলে সারাদিন লেগে যাবে। সুতরাং বাইরে থেকেই স্বাদ মেটাতে হলো। জাতীয় মসজিদ : ১৮ টি ছাতার আদলে পাঁচটি পিলারের উপর দাঁড়ানো ন্যাশনাল হেরিটেজের অংশ এই জাতীয় মসজিদ। আমরা যখন চত্তরে প্রবেশ করলাম তখন অন্তত ৩০/৪০ জন বিদেশি পর্যটক লাইনে দাঁড়ানো। তাঁদের
বেশির ভাগই নারী। বয়সে কিশোরী-তরুণী। তারা সবাই শর্ট ড্রেসে মসজিদ ঘুরতে এসেছে বলে বোরখার মতো মেটে রংয়ের একটি কাপড় পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওটা পড়লে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে ছেলে-মেয়েরা সেটা পরে ভেতরে ঢুকছিল। আমাদের অবশ্য কিছু পরানো হলো না, আমাদের ড্রেস খোলামেলা ছিল না বলে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার পর বিশাল চত্তর। অনেকগুলো করিডোরে চলে গেছে। নামাজের মূল জায়গাটি ছিল মাঝখানে। সেখানে কাওকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। তবে ছবি তুলতে বাঁধা ছিল না। মসজিদের এক পাড়ে কবরস্থান। সেখানে বিদেশি তরুণ-তরুণীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলেন। ছবিও তোলা হচ্ছিল। আমরা বিভিন্ন চত্তর ঘুরে বেরিয়ে এলাম। মনে মনে একটা জিনিস বুঝলাম, আমাদের দেশে এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই। মসজিদকেও যে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া যায়- তার কোনো ধারণাই নেই আমাদের দেশের মোল্লাদের। আর কখনও সে ব্যবস্থা করা হলে সেখানে বিদেশিদের, বিশেষ করে অন্য ধর্মাবলম্বীদের এভাবে ঢুকতে দেওয়া হবে কিনা- তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থাকবে। হানিফ্ফা মার্কেট : হোটেল বয়দের কাছ থেকে জানলাম জিনিসপত্র কম দামে পাওয়া যায় হানিফ্ফা মার্কেটে। দুপুরে খাবার সময় রসনা বিলাস হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে এ বিষয়ে ধারণা নিলাম। তিনি জানালেন, জিনিসপত্রের দাম কম বটে, তবে সেখানে বেশি সময় ঘোরাঘুরি না করাই ভাল। কারণ ওটা ইন্ডিয়ানদের এলাকা। নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব আছে। আর এ মার্কেট কাছে হলেও বেশ ঘুরপথ। সে কারণে ট্যাক্সি ভাড়া করে যাওয়াই ভাল। তিনি ভাড়াও বলে দিলেন। এইসঙ্গে সাবধান করে দিলেন, চালকরা খুবই ধূরন্ধর। নানা অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে দেবে। মিটারে ছাড়া গাড়িতে যেন না উঠি।
কথা মতো মিটারে যাওয়ার গাড়ি খুঁজছিলাম। কিন্তু কেউ রাজী হচ্ছিল না। শেষে এক চালকের সঙ্গে চুক্তি করে উঠলাম। পরে বুঝেছিলাম প্রায় দ্বিগুন ভাড়া আদায় করেছে। ওই মার্কেটের নিচ তলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত ঘুরলাম। কিন্তু মাইডিনে যে দাম দেখেছিলাম, তা থেকে এখানে সব জিনিসের দাম বেশ বেশি মনে হলো। আর মানও ততো ভাল লাগলো না। মার্কেটে আসা লোকজনও বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান। আসার সময় আসাপাশের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সবখানেই নোংরা এবং ভারতীয় পোশাক পরাদের ভিড় দেখেছিলাম। জায়গাটাকে মোটেই বিদেশ মনে হচ্ছিল না। বাংলাদেশ-ভারতের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। জিনিসপত্রের দাম দেখে বেশিকিছু না কিনে মাইডিনে যাওয়ার চিন্তা করে মার্কেট থেকে বেরিয়ে এলাম। এবারে মিটারে যাওয়া গাড়ি পেলাম। খুব চমৎকার। ড্রাইভারও শিক্ষিত। আগের গাড়ির চেয়ে অর্ধেক ভাড়ায় আমাদের হোটেলে নামিয়ে দিলো। পরে সন্ধ্যে বেলায় গিয়ে মাইডিনে কেনাকাটা করলাম। মনে হলো, এই মার্কেটটা নতুন। যে কারণে অনেকেই এটার অস্তিত্ব জানে না। আমরা এসেই এটার খোঁজ পেয়ে গেছি। এখানে জিনিসের মান খুব ভাল এবং দামও কম।
যা কিছু জানলাম : মালয়েশিয়া মুসলিম দেশ হলেও মৌলবাদী দেশ নয়। এখানে ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি নেই। নেই পোশাক-আশাকে বিধি-নিষেধ। চিন্তা-চেতনায়ও আমাদের দেশের মতো মৌলবাদী মানসিকতা নেই। ইচ্ছে করলেই শর্টকার্ট ড্রেস পড়ে অর্ধ নগ্ন হয়ে যে কেও চলতে পারেন। আবার হিজাব পড়েও চলতে পারেন। এ নিয়ে কারও কিছু বলার নেই। কোনো নারীকে অপমান করার অধিকারও নেই। করলে সঙ্গে সঙ্গে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দিয়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে মুসলমানদের জন্য আলাদা কিছু আইন আছে। যেমন তাদের জন্য মদ নিষিদ্ধ। অন্যদের বেলায় এ আইন প্রযোজ্য নয়। উন্নয়নের দিক থেকে মালয়েশিয়া আমাদের দেশ থেকে অনেক উপরে উঠে গেলেও দুর্নীতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। পুলিশের অনৈতিক ভূমিকার অভিযোগ রয়েছে আমাদের দেশের মতোই।
তারা পদে পদে ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। এমনকি সিন্ডিকেট করে চাইনিজ বাজার প্রতিষ্ঠায় পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত মাসোহারায় কারবার করার অভিযোগ রয়েছে। আছে এসব নিয়ে ভয়াবহ রকমের মাস্তানি। দুর্বল শক্তিগুলো এখানে একেবারেই অসহায়। দেশটির সাবেক এক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে আমাদের দেশের এরশাদ-খালেদার মতো দুর্নীতির অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে দেশের অর্থ লুটপাট করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ মুখে মুখে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার বৈশিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের উপর নির্ভরশীলতা। দেশটির গোটা অর্থনীতি দখল করে আছে চীন আর ভারত। কথায় কথায় অনেকেই জানান, ভারতের- বিশেষ করে তামিলদের একাধিপত্য রয়েছে মালয়েশিয়ায়। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য-গান-বাজনায় এ অবস্থা। অথচ ভারতের জায়গায় থাকার কথা ছিল মুসলমান দেশ বাংলাদেশের। এটা নাকি হয়নি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের কারণে। দেশের উন্নয়নের জন্য মালয়েশিয়া প্রথমেই বাংলাদেশে নাগরিকদেরকে মালয়েশিয়ার নাগরিক করে কর্মসংস্থান করে দিতে চেয়েছিল। তখন জিয়ারউর রহমান দেশটি দেখার জন্য মালয়েশিয়া সফরে এসেছিলেন।
তাকে সংবর্ধনা জানাতে এসেছিল মালয়েশিয়ার সবচেয়ে সুন্দরিরা শর্ট পোশাক পরে। এটা দেখে নাকি জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এতো স্মার্ট দেশে বাংলাদেশিদের আসতে দেওয়া যাবে না। তিনি মালয়েশিয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর ভারতকে সে প্রস্তাব দিলে তারা লুফে নিয়েছিল। সেই থেকে ভারতীয়দের মালয়েশিয়ায় বসতি এবং একাধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। আর বাংলাদেশিরা আজ এখানে কুকুর-বিড়ালের মতো নিগৃহীত হচ্ছে। বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানে আজও এখানে কঠোর বিধিনিষেধ। অবৈধভাবে বহু বাংলাদেশি এসেছেন, আর তারদের ধরে ধরে জেলখানায় ঢোকানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার সব জেলখানাই নাকি বাংলাদেশি নাগরিক দিয়ে ভর্তি। সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে তাদের। সবই সামরিক শাসক জিয়ারউর রহমানের কারণে! মালয়েশিয়ার সেই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জ্বালা আজও ভুলতে পারেনি। আমরা যে বাঙালি হোটেলে খাচ্ছিলাম, সেখান থেকে বেশ কিছু তথ্য জানতে পারলাম। এখানে নাকি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়া মাত্র উধাও হয়ে যাবে প্রায় সব বাংলাদেশি। প্রচুর বাংলাদেশি অবস্থান করে এই এলাকায়। আর তার বেশিরভাগই অবৈধ পথে আসা। সে কারণে অভিযান দেখা মাত্র যে যেমন পারে পালিয়ে
যায়। অভিযান শুরু হওয়া মাত্র এই হোটেলও মুহূর্তের ভেতর ফাঁকা হয়ে যাবে। এই হলো বাংলাদেশিদের অবস্থা। আমরা ফেরার দিন বিমান বোঝাই করে বাংলাদেশি জেলখাটাদের দেশে ফেরত পাঠাতে দেখলাম। এয়ার এশিয়ার ৯৮ ভাগ আসনেই ছিল এরা। একদল পুলিশ হাতকড়া পরানো অবস্থায় এদের বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। তারপর বিমানে তুলে দিয়ে চলে যায়। এই বাংলাদেশিদের শরীরে ছিল মারপিটের নানা চিহ্ন, পোশাক ছিল ছোঁড়াফাঁটা, কেউ কেউ ছিল অর্ধ উলঙ্গ। মাথা ন্যাড়া এসব মানুষগুলোকে দেখাচ্ছিল অভুক্ত কঙ্কালসার। রোগে শোকে সবাই ছিল কাতর। এরা নাকি অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় ঢুকে কাজ করছিল। কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গেও ছিল যুক্ত। জেলখানায় এদের পৈশাচিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। তারপর দেশে পরিবারের তরফ থেকে মোটা টাকা পাঠানোর পর মুক্তির ব্যবস্থা করে বিমানে তুলে দেওয়া হলো। মালয়েশিয়ার আরেকটি ভাল দিক হলো- এখনে রোগ-বালাই, অসুক-বিসুক নেই। বাঙালি হোটেল কর্মচারিরা জানালো- তারা এতো বছর হলো এসেছে, কিন্তু কোন দিন পেটের ব্যাথা হয়নি, গ্যাস্ট্রিক হয়নি, জ¦র হয়নি। কোন সময় কোন অসুখ হয়নি। এখানে তেমন একটা ওষুধপত্রের দোকানও নেই। কারণ অসুখ নেই। ওষুধ খেতে হয় না। এর কারণ এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যকর, খাবার-দাবার বিশুদ্ধ। আমাদের দেশের মতো ভেজাল নয়। ওরা জানালো, দেশে গেলেই নানান অসুখ জেঁকে বসে। এখানে ফিরে এলে ঠিক হয়ে যায়। ছবির ক্যাপশন : ১. ন্যাশনাল মন্যুমেন্টের সামনে লেখক ২. ন্যাশনাল মন্যুমেন্টের পাশে ৩. কিংস প্যালেসের সামনে ৪. একটি শপিং মলে মল কর্মির সঙ্গে লেখক ৫. কুয়ালালামপুরের সড়কে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message