শনিবার, ৫ জুন, ২০২১

দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : তিন)


                                                                         শিলিগুড়ি শহর
                                                                            হোটেল অঞ্জলী লজ
                                                                        

                                                            মার্কেটে কোনাকাটার দৃশ্য

                                                                    মার্কেটে কোনাকাটার দৃশ্য

দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : তিন)

ইয়াসমিন হোসেন

 

মার্কেট দেখা :

বিকেলে শিলিগুড়ি শহর দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের গেটে দাঁড়িয়ে বামে তাকালাম, রাস্তা নিচের দিকে ঢালু হয়ে গেছে ওই পথেই এসেছি ডানের দিকে সোজা রাস্তা অগত্যা নতুনত্বের আশায় ডানেই পা বাড়ালাম সামান্য এগুতেই প্রধান সড়ক দেখতে ঠিক আমাদের দেশের পল্টন মোড় থেকে মতিঝিল বা ধানমন্ডির শুক্রবাদ থেকে আসাদ গেটে যাবার পথের মতো তবে আমাদের পথ প্রস্থে বড়, এখানে খানিকটা ছোট সড়ক পথের দুধারে দোকান-পাট-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান-ব্যাংক-পেট্রোল পাম্প মাঝখানে ডিভাইডার যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে খাঁকি পোশাকপড়া ট্রাফিক লক্ষ্য করলাম আমাদের দেশে এরকম সড়কে এসময় প্রচন্ড ভিড় থাকে, আরও থাকে প্রাইভেট বাস-কার-সিএনজি-রিকশা-ঠেলার জট কিন্তু এখানে ওসব নেই ভিড় একেবারেই নেই, যানবাহন এবং লোক চলাচল কম সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এই নিরিবিলি পরিবেশেও কোন যানবাহন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করছে না সিগন্যাল পড়ামাত্র আপনা-আপনিই দাঁড়িয়ে পড়ছে অথচ যাবার রাস্তা ফাঁকা সিগন্যাল শেষ হলে তবেই ওগুলো চলছে লোকজনও ইচ্ছেমত রাস্তা পার হচ্ছেন না সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করছেন ফলে সব কিছু প্রথম দর্শনেই সুশৃঙ্খল মনে হলো আমাদেরও রাস্তা পার হয়ে ওপারে যাওয়া দরকার একটু অপেক্ষা করলাম অন্যদের মতো তারপর পার হলাম সামনেই ট্রাফিক ছিল, সে সহযোগিতা করে এগিয়ে দিলো। ছিমছাম এবং অত্যন্ত নিরিবিলি পথ ধরে এগিয়ে চলেছি মানুষজন ধীরে সুস্থে এগিয়ে চলেছেন আমাদের দেশের মতো তাড়াহুড়ো নেই লাইন করে যানবাহন চলে যাচ্ছে অযথা হর্ন বাজানো হচ্ছে না অবশ্য রিকশাগুলো মাঝে মাঝে পাশকাটানোর জন্য হাতেচাপা হর্ন প্যাঁক প্যাঁক করে বাজাচ্ছিল রাবারের বলে চাপ দেয়া এই হর্ন আমাদের দেশে অনেক আগে ছিল এখন এটাই এখানে চলছে লক্ষ্য করলাম রিকশাগুলো পাশ কাটানোর সময় লোকজন সরে দাঁড়াতে কখনও কখনও বিলম্ব করে ফেললেও রিকশাওয়ালা বিরক্ত না হয়ে থেমে পড়ছে আমাদের দেশে হলে রিকশাওয়ালাও গালি দিতো, পথচারীও পাল্টা গালি দিয়ে রুখে যেতো এখানে ওসব নেই স্বাভাবিকভাবে সবকিছু মেনে নিয়েই যেন জীবনযাত্রা আরেকটা ব্যাপার দেখলাম, কোন মানুষ এখানে অযথা ঘোরাঘুরি করছে না সবাই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত আমরা দুজনই যেন হাওয়া খেয়ে চলছি

মার্কেট খুঁজছিলাম বার বার জিজ্ঞেস করছিলাম কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে সেরকম কোন মার্কেট দেখতে পেলাম না ডান দিকে হাঁটতে হাঁটতে চারমাথামত মোড়ে এসে দাঁড়ালাম কোথাও মার্কেট জাতীয় কিছু চোখে পড়লো না বাধ্য হয়ে পাশের এক দোকানে ঢুকে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসে পথ দেখিয়ে দিলেন বললেন, মেইন রাস্তা থেকে সামনের গলিতে ঢুকলেই কেনাকাটার মার্কেট পাওয়া যাবে আমরা রাস্তা পার হয়ে ওই গলি পথে ঢুকতেই চোখের সামনে উদয় হলো বিশাল মার্কেট সাইনবোর্ড পড়ে জানলাম বিধান মার্কেট অথচ মেইন রাস্তা থেকে একটুও বোঝা যাচ্ছিল না ভেতরে এরকম একটি মার্কেট রয়েছে। এ মার্কেট আমাদের দেশের গাউছিয়া-মৌচাক মার্কেটের মতো বিপনী বিতানগুলোর সামনে কাপড়-চোপড়-ইমিটেশনসহ নানা কিছুর পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা লোকজনে ঠাঁসা বেশির ভাগ মানুষই নারী বিপনী বিতানগুলোতেও নারী বিক্রেতা, ফুটপাতের বিক্রেতারাও বেশিরভাগই নারী আরও লক্ষ্য করলাম কেনা-কাটা করতে আসা মানুষের মধ্যে ৯৫ ভাগই নারী আশপাশে অনেক পুরুষও আছেন লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এখানকার কোন নারী বা মেয়েই ওড়না ব্যবহার করেন না মেয়ে শিশু-কিশোরী-তরুণী-যুবতী-বয়স্ক মহিলা সবাই জিন্সের প্যান্ট এবং ছোটখাটো পাতলা গেঞ্জি অথবা শার্ট পড়ে চলাচল করছেন একেবারেই খোলামেলা অথচ কোন ছেলে বা পুরুষ তাদের দিকে অসৌজন্যমূলকভাবে তাকাচ্ছেন না আমাদের দেশে এরকম সাজে চলাচলের প্রশ্নই ওঠে না যদিও ঢাকার গুলশান-বনানীর অভিজাত এলাকায় এভাবে চলাচল আছে বটে, তবে সাধারণে এমনটা নেই এখানে সাধারণ পর্যায়েই এটা স্বাভাবিক বিষয় লক্ষ্য করলাম, এতো শর্টকাট এবং আঁটসাট পাতলা পোশাক পড়ে টিনএজ মেয়েরা স্বচ্ছন্দে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, অথচ কোন পাশ থেকে বাজে দৃষ্টিপাত নেই, টিজ বা ইভটিজিং নেই, আপত্তিকর কোন কিছুই নেই আমাদের দেশে হলে উত্যক্তের শেষ থাকতো না জানলাম, এটাই এখানকার বৈশিষ্ট এখানে কোন পুরুষ বা ছেলেই অশালীন আচরণ করবে না, কোন মেয়েকে উত্যক্ত করবে না, ধর্ষণ তো দূরের কথা চেতনা রুচিতেই নেই এসব এমন ঘটনার কোন খবরও মিলবে না তাই যে কোন সময় যে কোন অলিগলি ফাঁকা জায়গায় এভাবেই মেয়েরা নির্দিধায় নিশ্চিন্তে চলাচল করে কারণ কোন বত্যয় ঘটলে বা কোথাও কোন ছেলে বখাটেপনা করামাত্র সাধারণ মানুষই তার বারেটা বাজিয়ে ছাড়বে, পুলিশ বা কঠোর আইন তো আছেই

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে হইচই-হুড়োহুড়িমুক্ত পরিবেশে টিনএজ মেয়েদের প্রচন্ড ভিড় ঠেলে বিধান মার্কেট দেখছিলাম কেনাকাটার জায়গাগুলো ঠিক করে রাখছিলাম কারণ আমরা এখন কিছুই কিনবো না দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসার পর এসব চিন্তা করা হবে। মার্কেটের কোন কোনটিতে দেখলাম সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা বা গৃহিণীরা হয় চায়ের দোকানদারী করছেন, নয় স্টেশনারি দোকান চালাচ্ছেন, কসমেটিকস-জুতা-হাতব্যাগ-শিশুদের জামাকাপড় বিক্রি করছেন চেহারা দেখেই বোঝা তারা হয় অধ্যাপনা করেন, অথবা শিক্ষিত এবং ভাল কোন চাকুরে কাজের অবসরে বাড়তি আয়ের জন্য দোকান চালাচ্ছেন আমাদের দেশে এমনটা স্বপ্নেও ভাবা যায় না এইসব দোকানী মহিলা বা পুরুষদের ব্যবহার এতো চমৎকার এবং আন্তরিক যেÑ সহজেই আপন বলে ভাবতে ইচ্ছে করে এসব দেখে ভারতীয় মানুষ সম্পর্কে খারাপ ধারণাটা একেবারেই বদলে যাচ্ছিল কারণ দেশে থেকে শুনেছিÑ ভারতীয়রা সাংঘাতিক কৃপণ, স্বার্থপর, ফাঁকিবাজ, তাদের আন্তরিকতার লেশমাত্র নেই কিন্তু বাস্তবে যতোই দেখছি ততোই ওসব মিথ্যে প্রমাণিত হচ্ছে শেষে নিশ্চিতই হয়ে গেলামÑ এদের মতো দেশপ্রেমিক, কর্মঠ, শান্তিপ্রিয়, সুশৃঙ্খল এবং নীতিনিষ্ঠ প্রেক্ষাপট আমাদের দেশে নেই নীতিনিষ্ঠর কথা বলছি এই কারণে যে, আমাদের দেশে মানুষ ঠকানোর চিন্তাটা সবখানে কিন্তু এখানে ধরণের কোন বিষয়ই খুঁজে পেলাম না জিনিসপত্র দামদর করাকে পর্যন্ত এরা ভাল চোখে দেখে না দামদর করলেই বুঝে ফেলে আমরা এখানকার নই আসলে তারা দামাদামি বা ঢাকার হকার্স মার্কেট বা বিপনী বিতানগুলোর মতো এক দাম হেঁকে আরেক দামে বিক্রির মানসিকতায় বিশ্বাস করে না তাঁদের চরিত্রটাই হয়ে উঠেছে রকম হয়তো একসময় এমনটি ছিল না হয়তো সেই আগের অবস্থার আলোকে এখনও বাংলাদেশের অনেকে তাদেরকে বিচার-বিবেচনা করেন আর সে কারণেই হয়তো নেতিবাচক ধারণা নিয়ে এখনও বসে আছেন

জানলাম এখানকার সর্বস্তরের মানুষ আইন শৃঙ্খলা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন তাঁরা রাত টার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে ফেলেন রাত ৯টার পর কোন হোটেল বা পান-বিড়ির দোকান পর্যন্ত খোলা পাওয়া যাবে না রাস্তায় কোন মানুষজনও পাওয়া যাবে না আবার সকাল ৭টার আগেও দোকানপাট-হোটেল-যানবাহন ইত্যাদি কিছুই চালু অবস্থায় পাওয়া যাবে না একেবারে ঘড়ির কাটায় কাটায় এখানকার মানুষ জীবন-যাপন করেন

ঘেরাফেরার পর মার্কেট থেকে রওনা হলাম হোটেলের পথে পাসপোর্ট সঙ্গেই ছিল ভাবলাম অতিরিক্ত কয়েক কপি জেরক্স করে রাখি পাশেই জেরক্সের একটা দোকান দেখে কপি করতে দিলাম ভদ্রলোক কম্পিউটারাইজড মেশিনে জেরক্স করলেন কথায় কথায় আলাপ জমে গেল দোকানীর সঙ্গে বললেন, তার বাড়ি কলকাতায়, এখানে এখন থাকছেন কলকাতার চেয়ে এখানকার মানুষ অনেক বেশি দায়িত্বশীল তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে খুব উদ্বেগ প্রকাশ করলেন কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বেড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন বললেন, বঙ্গবন্ধু সেতু দেখার খুব ইচ্ছা। ওখান থেকে বেড়িয়ে মোবাইলে টাকা ভরার কাজ শেষ করে হোটেলের পথে এগুলাম এসে ম্যানেজারের কাছে বিলপত্র জমা দিয়ে দার্জিলিংয়ে হোটেল পাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলাম এই শিফটে যিনি ম্যানেজার ছিলেন তিনি বললেন, ‘আমি এখান থেকে হোটেল বুক করে দিতে পারি, তবে সেটা করতে চাই না এই কারণে যেÑ ওখানে গিয়ে হোটেল পছন্দ হবে না এই ভাড়ায় এইরকম হোটেল ওখানে পাবেন না এই হোটেলের ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুন-চারচগুন বেশি ভাড়া হবেÑ তারপরেও এই হোটেলের মতো ভাল হোটেল মিলবে না তাই ওখানে গিয়ে হোটেল ঢুকে দেখেশুনে ভাড়া মিটিয়ে নেয়াই হবে সবচেয়ে ভাল কাজ ম্যানেজার আরও জানালেন, এখন সিজন নয়, তাই অনেক হোটেল পাবেন আর হোটেলের এজেন্টরা বাসস্ট্যান্ডেই অবস্থান করে গাড়ি থেকে নামামাত্রই ওরা আপনাদের ডেকে নেবে আপনারা নিশ্চিন্তে তাদের সঙ্গে গিয়ে রুম দেখে ভাড়া মিটিয়ে নেবেন যা চাইবে তারচেয়ে কিছু কমে ভাড়া মেটাবেন কারণ এখন সিজন নয় বলে একটু ছাড় দিয়ে থাকে ওরা সিজনের সময় ভাড়া কয়েকগুন বেড়ে যায় এবং হোটেলও খুঁজে পাওয়া যায় না ফলে অনেক টুরিস্টই চৌমাথা এলাকায় ফুটপাতে রাত কাটাতে বাধ্য হন প্রচন্ড শীতে এভাবে রাত কাটানো খুব কষ্টকর এখন অবশ্য প্রচুর খালি সিটের হোটেল মিলবে

রুমে ঢুকে ফোন করে খাবারের অর্ডার দিলাম এই ফাঁকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম

 

--------- চলবে ---------

1 টি মন্তব্য:

Thanks for Message

সৌদি আরবের পথ [The way to Saudi Arabia]

       সৌদি আরবের পথ [The way to Saudi Arabia] The way to Saudi Arabia [সৌদি আরবের পথ] : This short documentary is compiled from video foot...