টাইগার হিল টাওয়ারে লেখক |
সূর্যোদ্বয় দেখতে ভিড় |
সূর্য ওঠা |
|
দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : আট)
ইয়াসমিন হোসেন
রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেল। একঘণ্টার মধ্যে দুজন প্রস্তুত শেষ করলাম। আমার জর চলে গেছে। গিজারের গরম পানিতে স্নান করায় ভাল কাজ হয়েছে। তখন বাজে ৪টা। দরজায় টোকা পড়লো। রুম সার্ভিস ঘুম ভাঙাতে এসেছে। ওকে জানালাম, আমরা আগেই উঠে পড়েছি।
সাড়ে ৪টার আগেই রুম সার্ভিস আবার চলে এলো। চা ও বিস্কুট সরবরাহ করে জানালো, ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত। চা পান করে আমরা যেতে পারি। সম্মতি জানিয়ে ওকে বিদায় জানালাম। আমরা গরম সোয়েটার গায়ে চড়ালাম, আরেকটা মোটা সোয়েটার হাতে নিলাম। মাফলার, ফেল্ট ক্যাপ ইত্যাদিও নিলাম। ঠিক সাড়ে ৪ টায় রুম থেকে বেরুলাম।
বাইরে মাইক্রো অপেক্ষা করছিল। উঠে পড়তেই রওনা হলো। রাতের অন্ধকার কোন রকমে দূর করছিল ফাঁকা সড়কপথের স্ট্রিট লাইট। একটা ভুতুরে পরিবেশ। সরু পথে তেমন লোকজন নেই। তবে ট্যাক্সি চোখে পড়ছিল মাঝে মাঝে। আমাদের মারুতি দ্রæত ছুটছিল আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে উপরের দিকে। আধা ঘণ্টা চলার পর দেখলাম আরও অনেক গাড়ি ছুটছে এই পথ ধরে। যাত্রী নিয়ে সব গাড়ি চলছে টাইগার হিলে সূর্যদ্বয় দেখাতে।
দার্জিলিং শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে এই টাইগারহিল। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ২,৬০০ মিটার অর্থাৎ ৮,৫০০ ফুট। এই হিসাবে দার্জিলিং শহর থেকে আরও সাড়ে ৫শ মিটার উঁচুতে টাইগারহিল টাওয়ার। এখান থেকেই দেখতে হয় সূর্যদ্বয়। এই স্থান থেকে বেশ দূরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত সৃঙ্গ হিমালয়। এখান থেকেই মেঘমুক্ত অবস্থায় সূর্যদ্বয় বা সূর্যস্তের সময় এই সৃঙ্গ খালি চোখে দেখা যায়। দেখা যায় ভারত-নেপাল সীমান্তে অবস্থিত কিংবদন্তির কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত চূড়া। এটি সমূদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৮,৫৮৬ মিটার অর্থাৎ ২৮, ১৬৯ ফুট উঁচু।
বিরাট পাহাড়ী এলাকা ঘুরতে ঘুরতে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে টাইগারহিলে পৌঁছে গেল আমাদের মাইক্রো। ড্রাইভার তার মোবাইল নম্বর এবং গাড়ির নম্বর জানিয়ে আমাদের টিকেট কেটে সামনের দিকে উঠে যেতে বললেন। জানালেন উঁচুতে উঠতে ৩/৪ মিনিট লাগবে।
তখনও চারদিকে আবছা অন্ধকার। তবে গোটা এলাকায় অগণিত মানুষ এবং গাড়ির ভিড়। সবাই ছুটে এসেছেন সূর্যদ্বয় দেখতে। আমরা টিকেট কাউন্টার লেখা ভবনে গিয়ে দুটো টিকেট চাইলাম। দাম রাখা হলো ২০ টাকা। তখনও জানতাম না দুই ধরনের টিকেট পাওয়া যায়। এরমধ্যে সাধারণ টিকেট ১০ টাকা করে, আর বিশেষ টিকেট ২০ টাকা করে। বিশেষ টিকেটে টাইগার হিলের উঁচু টাওয়ারে উঠে সূর্য দেখা যায়। আর সাধারণ টিকেটে টাওয়ারের নিচের দিকটা থেকে দেখতে হয়। যদিও টাওয়ার নিচের দিকটা থেকে তিনতলা সমান উঁচু। না জানার কারণে আমরা সাধারণ টিকেট নিয়েই ছুটলাম সূর্যদ্বয় দেখার মঞ্চের দিকে। ৩/৪ মিনিট লাগলো। গাড়ির স্টপেজ থেকে উপরের দিকে রাস্তা বামের দিকে মোড় ঘুরে উঠেছে টাওয়ার মঞ্চে। আমরা যখন সূর্যদ্বয় দেখার জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়েছি তখন বাজে পৌনে ৬টার বেশি। উপচে পড়ছিল দর্শনার্থী। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নড়াচড়ার উপায় নেই। সরে গেলে জায়গা হারাতে হবে। সুতরাং দু’জন প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ক্যামেরায় ছবি ধারণ করতে যেটুকু নড়াচড়া করা দরকার সেটুকুও মিলছিল না।
অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। সূর্য উঠার সময় আরও ১০/১৫ মিনিট পর। এটুকু সময় ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এদিকে হাড়ের ভেতর ঢুকেপড়া কনকনে শীত একেবারে বেসামাল করে তুলছিল। হাতের কব্জি পর্যন্ত অবশ হয়ে গেছে। যদিও এইদিনটিতে আবহাওয়া খারাপ ছিল না। প্রবল বাতাস ছিল না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই প্রবল বাতাস থাকে, কুয়াশার মেঘ হানা দেয়, ঝড় হয়, মেঘবৃষ্টিও হয়। এটা কোন রকম জানান দিয়ে ঘটে না। দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনা ঘটে যায়। অনেক মহিলা কফির বিশাল ফ্লাক্স কাঁধে ঝুলিয়ে কফি কফি বলে চিৎকার করছিলেন। একজনকে ডাকতেই ওয়ান টাইম ইউজের প্লাস্টিক গ্লাসে দু’কাপ কফি দিলেন। দাম নিলেন ১০ টাকা করে। কিন্তু গরম কফিও ঠান্ডাকে ঘায়েল করতে পারলো না। পাশে দাঁড়ানো একজন বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে তাঁর তিনদিন অপেক্ষার বর্ণনা করছিলেন। আজকের দিনটি তাঁর চতুর্থ দিন। তিনি যা বলছিলেন তার মর্ম কথা হলো, গত তিনদিন তিনি টাইগারহিলে সূর্যদ্বয় দেখতে এসেছেন, কিন্তু সূর্য উঠেনি। মেঘ থাকার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। আসলে সূর্য ঠিকই উঠেছে কিন্তু মেঘের কারণে উদয় দেখা যায়নি। তিনি বলছিলেন, আজও হয়তো দেখা যাবে না। তিনি পঞ্জিকার নানা তিথির ব্যাখা দিলেন। তাঁর কথা শুনে বেশ হতাশ হলাম। আমরা তো তাঁর মতো অপেক্ষা করতে পারবো না। আজ যদি ভাগ্যবান না হই তাহলে হয়তো আর এখান থেকে সূর্যদ্বয় দেখাই হবে না। সব আশা শেষ হয়ে যেতে পারে এ আশঙ্কায় ভুগতে লাগলাম। কিন্তু না। ভাগ্য বড় সহায় ছিল। ঠিক ৬টা ৫-এর দিকে পূব আকাশ টকটকে লাল হয়ে উঠলো। আর দু’মিনিটের ভেতর হুট করে সূর্য মাথা বের করলো। আর কোন অপেক্ষা না করে প্রথমে কমলা, পরে উজ্জ্বল স্বর্ণের রংয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগলো সূর্য দেবতা। মুহূর্তের মধ্যে তা উজ্জ্বল সাদায় মেশানো স্বর্ণের রংয়ে ভেসে উঠলো। একেবারে লাফিয়ে বের হওয়ার মতো। ভিডিও করা যেতো। কিন্তু ক্যামেরায় মেমোরি কার্ডের স্পেশের কথা ভেবে সিম্পল ফটোশর্ট নিতে থাকলাম। দুই মিনিটের ভেতর সূর্য স্বাভাবিক রূপ নিয়ে ফেললো। চারদিকে উজ্জ্বল আলোর আভায় ভড়িয়ে উঠলো।
এতোকিছু এবং উত্তেজনার মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং হিমালয় পর্বতের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পেছনেই ছিল এসব। কিন্তু ভুলে যাওয়ার কারণে পিছু হটতে গিয়ে টাইগারহিল টাওয়ারের পাশে কয়েকটি ছবি নেয়ার জন্য অগ্রসর হলাম। তখনই অনেক দূরে ঝকঝকে সাদা এবং পরে লালাভ কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়া দেখতে পেলাম। বরফে ঢাকা এবং তীক্ষè ছোড়ার মতো ধারালো চূড়ার সারি। এই চূড়াই এখন লাল এবং সাদায় রূপ নিয়ে আছে। পরে এ রূপ পাল্টে হয়ে যাবে কমলা, বেগুনি, নীল, সবুজ এবং সোনালী। মেঘের ভেতর দিয়ে অপূর্ব দেখাচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। দূর্লভ দৃশ্য দেখার পর ফেরত যাওয়ার পালা। অন্য সবাই আস্তে ধীরে নিচের পথে পা বাড়াচ্ছিলেন। আমরাও এগুলাম। জায়গামত আমাদের মাইক্রো পেয়ে গেলাম। ঘড়িতে বাজে ৭টা মত। চারপাশে গাড়ি এবং মানুষের এতো ভিড় যে পা ফেলা কষ্টকর। তারচেয়েও বড় কথা দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো হঠাৎ করেই চলা শুরু করছিল। এতে মানুষ ও গাড়ির জট বাড়ছিল। কারণ রাস্তার প্রশস্ততা কম। কোন রকমে একটা গাড়ি আরেকটাকে ওভারটেক করতে পারে। মানুষের ভিড়ের কারণে এই ওভারটেক আটকে যাচ্ছিল। আমরা মাইক্রোতো উঠতেই ভিড় ঠেলে এগুতে থাকলো। ----------- চলবে ----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message