শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
হাড় কাঁপানো শীতকাল। খুব ভোরে ঘুম ভাঙতো রাহুলের। তখন ও খুবই ছোট। দৌড়ানো শিখেছে। থাকতো পূর্বমুখি লম্বা মাটির মেঝের ঘরে। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কাঁথার নিচ থেকে লুঙ্গি পেচানো শরীর নিয়ে বেরিয়ে এসে প্রথমে কাঠের দরজার খিল তুলে দিতো। তারপর কিছুক্ষণ হাড় জিরজিরে শরীরটাকে চৌকাঠে বসিয়ে খসখসে পায়ের ফাটা জায়গাগুলোতে হাত বুলাতো। ঠাণ্ডায় জমে শক্ত হয়ে যাওয়া জায়গাগুলোয় রস জমে থাকতো। হাত, পা, মাথা, শরীর ছিল খোচ-পচড়ায় ভর্তি। ব্যথা আর যন্ত্রণায় কোঁকানো ছাড়া কিছু করার ছিলনা। ওগুলো নিয়েই আস্তে ধীরে বরফের মতো খটখটে মাটিতে পা জোড়া রাখতো। তারপর ডান পাশের হলুদ ক্ষেত দেখতে যেতো। ব্যথার শরীর নিয়ে কোন রকমে ক্ষেতের সারি সারি আইলের মতো গর্ত দিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করতো। তখন হলুদের পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশির ওকে ভিজিয়ে দিতো। এদিক ওদিক হেঁটে ও থমকে দাঁড়াতো মাকড়সার জালভর্তি শিশিরের সামনে। দেখতো কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছে মাকড়সা। রাহুল অস্তে আস্তে টোকা দিয়ে শিশির ঝরিয়ে দিতো। তখন মাকড়সা একটু নড়েচড়ে উঠতো। রাহুলের মনে হতো, ওর টোকায় বুঝি পোকাটি রক্ষা পেলো। নয়তো ঠাণ্ডায় জমে মারা যেতো। ও তখন দু-একটা পিঁপড়া বা পোকা ধরে জালে ফেলতো, যাতে ও সেটা খেতে পারে।
কখনও কখনও ক্ষেতের ভেতর শিয়াল কিংবা বেজী দেখতে পেতো রাহুল। ওকে দেখে ওগুলো কড়া চোখে তাকিয়ে আস্তে আস্তে চলে যেতো। রাহুল ভয় পেয়ে ফিরে আসতো। আবার কখনও কখনও বড় বড় ব্যাঙ চোখে পড়তো। ওগুলোকে ও তাড়িয়ে বেড়াতো।
যখন ও আরেকটু বড় হলো তখন বিরাট জায়গাটার চার পাশদিয়ে দৌড়ে বেড়াতো। চেষ্টা করতো বাবার সাইকেলটা চালানোর। ওটা ধরে রাখার শক্তি ওর ছিলনা। তারপরেও ঘরের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা সাইকেল সোজা করে দাঁড় করাতো। এটা করতে গিয়ে একদিন গায়ের উপর সাইকেল পড়ে গেল। ভেঙে গেল ওর বাম হাত। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফিরেছিল ব্যান্ডেজ বাধার পর। তারপর বেশ ক’মাস ব্যান্ডেজ নিয়ে চলতে হয়েছিল। এ কারণে ও অবশ্য দমে যায়নি। ছ’মাসের মধ্যে সাইকেলের মাঝামাঝি দিকে ঢুকে পড়ে চালানো শিখে ফেলেছিল। এই শিখতে গিয়েও একবার বাড়ির পাশের কাদা ভর্তি ডোবায় পড়ে গিয়েছিল। ও-সহ সাইকেল ডুবে গিয়েছিল ডোবায়। কিন্তু এসবে হাল ছাড়েনি ও।
রাহুল আরেকটু বড় হলো। এরই মধ্যে ওর কাজের চাপ বেড়ে গিয়েছিল। বাড়িতে থাকলে আজান দিয়ে পাঁচ ওয়াক্তো নামাজ বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হয়। স্কুলে থাকলে যোহর আর আছর থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। বাবার সঙ্গে হাটে-বাজারেও যেতে হয়। সব রকম ফাই-ফরমাস খাটতে হয়। মায়ের ফাই-ফরমাসও খাটতে হয়। গাছ থেকে লাউ, বেগুন, শাক তুলে দিতে হয়। ছোট ভাই-বোনগুলোকে কোলে রাখতে হয়। হাঁটাহাঁটি করে এদিক-সেদিক ঘোরাতে হয়। বোনগুলোর চুল বেধে দিতে হয়। ওদের পায়ে আলতা লাগাতে হয়। এগুলো ছাড়াও ও নিজের উদ্যোগে বাড়ির সীমানা পর্যন্ত প্রতি মাসে একবার হাঁসুয়া বা কোদাল দিয়ে কেটে কেটে জঙ্গল পরিস্কার করে। দেবদারু গাছগুলোতে লিকলিকে শরীর নিয়ে সটান উঠে পড়ে কেছেছেটে পরিস্কার করে। অনেক জায়গায় প্রতিদিন ঝাড়ু দিয়েও পরিস্কার করে।
ওর বন্দি জীবন। বাড়ির বাইরে বেড়ানো নিষেধ। তারপরেও এতোসব করে সুযোগ পেলেই ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। পাড়ার বন্ধুগুলোর সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। ওদের সঙ্গে প্রতিবেশির এটাসেটা কাজ করে দেয়। দরকার হলে ডোবা-নালার ময়লা পরিস্কার করে দেয়। গাছ থেকে ফলমূল তুলে দেয়। দল বেধে মানুষের উপকার করতে দারুণ লাগে। কখনও কখনও খেলাধূলায় মেতে উঠে। সব সময়ই বাবাকে ফাঁকি দিয়ে এসব করা হয় না। টের পেলে বেদম মারপিট খেতে হয়। পালাতে দেওয়ার জন্য মাকেও লাঠিপেটা খেতে হয়।
বন্দি জীবনটা অসহ্য হয়ে উঠছিল। একেবারে দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। নিজেকে সামলাতে রাহুল কখনও গ্যারেজের গাড়ির ভেতর ঢুকে ভূতের মত বসে থাকে। চোখের পানি ফেলে। কখনও পেয়ারা গাছে বসে ঝিমোয়। আবার কখনও দক্ষিণ পাশের আম গাছ তলায় লতাপাতার ভেতর মাকরসার সঙ্গে খেলে বেড়ায়। অথবা পূর্ব কোণায় সীমানা বরাবর রাখা পায়খানার ভেতর বসে থাকে। কোন কিছুই ভাল না লাগলে বাড়ির পশ্চিম থেকে দক্ষিণ হয়ে পূর্ব, তারপর উত্তর হয়ে পশ্চিমে দৌড়ায়। অথবা হাঁটে। বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ও পাঁচ ওয়াক্তো নামাজেই দুহাত তুলে একটাই প্রার্থনা করে- যেন এই জীবন থেকে মুক্তি পায়। খোঁদার উপর ওর অগাধ বিশ্বাস। ও নিশ্চিত- একদিন আল্লাহ ওর কথা ঠিকই রাখবেন।
কেন ওর উপর এতো অত্যাচার? এ প্রশ্ন নিয়ে অনেকে ভেবেছে রাহুল। মন মেজাজ ভাল মনে হলে বাবাকেও প্রশ্ন করেছে। জবাবে জেনেছে, ‘এটা নাকি আল্লাহর নির্দেশ। বাবা-মার পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত। তাদের কথা সন্তানদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করা বাধ্যতামূলক।’ রাহুলের অবশ্য এ কথা বিশ্বাস হয় না। আল্লাহ কি কখনও নিষ্ঠুর হতে পারেন? কখনই না। তিনি দয়ালু, দয়ার সাগর। বাবা কেন আল্লাহর নামে এরকম বদনাম তৈরি করেন- তা ও ভেবে পায় না। একবার রাহুল বাবাকে জিজ্ঞাস করেছিল, ‘আপনি আল্লার নির্দেশ কোথা থেকে পান?’ খুব রেগে গিয়ে আহেদ জবাব দিয়েছিল, ‘আমি আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আমার সঙ্গে তার সবসময় যোগাযোগ হয়। তিনি যেভাবে আমাকে বলেন, আমি সেইভাবে করি।’ রাহুল আর কোন কথা বলার সাহস পায়নি। তবে ওর কাছে বাবার দাবি সত্য বলে মনে হয়নি। কারণ আল্লাহর প্রিয় বান্দারা কখনও খারাপ হতে পারেন না, মানুষকে ঠকাতে পারেন না, অত্যাচার-নির্যাতন করতে পারেন না। বান্দারা ফেরেস্তাতুল্য। নবীরা যেমন ছিলেন, তেমন। বাবার সঙ্গে এসবের কোন মিল নেই। রাহুলের বিশ্বাস- আল্লার বান্দা হবেন এমন যে, তাঁর দিকে চোখ পড়লেই মানুষ অভিভূত হয়ে যাবেন। যেমন নবীদের কাছে এসে অন্য ধর্মের মানুষরা অভিভূত হয়েছেন এবং মুহূর্তেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বাবা তো কাউকে অভিভূত করেন না!
রাহুল একবার বাবাকে বেশ কতগুলো প্রশ্ন করেছিল। সে জন্য প্রচণ্ড কানমলা আর চর থাপ্পড় খেতে হয়েছিল। পরে বাবা হাদিস-কোরান দেখিয়ে অনেক প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিল। যেমন মায়ের উপর অত্যাচর সম্পর্কে বলেছিল, ‘নারীরা হলো পুরুষের সেবাদাসী। পুরুষ বা স্বামীকে খুঁশি রাখাই তাদের কাজ। স্বামী যা বলবে তাই-ই তাদের অক্ষরে অক্ষরে করতে হবে। ঘরের সব কাজকর্ম, তোদের লালন-পালন করাও তার কাজ। নারী শুধু দাসীই নয়, পুরুষের ভোগের সামগ্রী। সে কারণে তাকে ঘরে থাকতে হয়। এক স্বামী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে তার কোন দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ নেই। অন্য কোন পুরুষের চোখে পড়া তার সম্পূর্ণ নিষেধ। এজন্যই তাকে পর্দা করতে হয়। এমনকি আত্মীয়-স্বজন তো দূরে থাক নিজের ছেলেরা বড় হয়ে গেলে তাদের দেখা দেওয়াও নিষেধ। তাতে পর্দা ভেঙে যায়। এটাই আল্লাহর বিধান।’ অশুখ-বিশুখে চিকিৎসা না করানো, ঠিকমতো খেতে-পড়তে না দেওয়া সম্পর্কে তার ভাষ্য, ‘অশুখ-বিশুখ, খাওয়া-পড়া এ সবের মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে যেভাবে রাখতে পছন্দ করেন, তাকে সেভাবে থাকতে হয়। তিনি মানুষকে অশুখ দিয়ে পরীক্ষা করেন, শাস্তি দেন। ক্ষুধা দিয়ে শিক্ষা দেন। অর্থ্যাৎ তার ইচ্ছে বা হুকুম ছাড়া কোন কিছু হয় না। গাছের পাতাও পড়ে না। সব তার হুকুমে চলে। এখানে কোন মানুষের মাতব্বরি করা নিষিদ্ধ। এটা করলে সে গুনাহগার হবে, তার উপর নাজাত পড়বে। তাই আমি আল্লাহর ইচ্ছাকে মর্যাদা দেই। তিনি যতো ইচ্ছা অশুখ দিক, ক্ষুধা দিক, কষ্ট দিক- সব মাথা পেতে নিতে চাই এবং তোদেরও নিতে বলি। তা না হলে জাহান্নামে যেতে হবে।’ রাহুলসহ বোনদের জামা-কাপড় কিনে না দেওয়া, ঠিকমত খাবার না দেওয়া সম্পর্কে আহেদ বলেছে, ‘দুনিয়াতে যতো কষ্ট, আখেরাতে ততো সুখ। তোদের সুখের জন্যই আমি সব করি। সুতরাং কষ্ট করাটাই প্রকৃত ইবাদৎ।’ এক পর্যায়ে এও বলেছে, ‘তোর মা, তুই আর তোর ভাইবোনরা আমার অবাধ্য হলে কঠিন শাস্তি ভোগ করবি। কোরান-হাদিসে অবাধ্যদের পরিত্যাগ করতে বলা হয়েছে। তাই তোরা যে কেউ আমার অবাধ্য হলে তোদের পরিত্যাগ করবো। বাড়ি থেকে সবাইকে বের করে দেবো।’ আরও বলেছিল, ‘তোরা কোন কিছুতে যখনই আমার অবাধ্য হয়েছিস, তখনই তোদের পিটিয়ে শায়েস্তা করেছি। তোর মাকে পেটাই একই কারণে। যখন পিটিয়েও কাজ হবে না তখন পরিত্যাগ করবো।’ এইসব বলার সময় আহেদ আলী কোরআনের আয়াত এবং হাদিসের ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে এই বক্তব্যের পক্ষে বিভিন্ন লেখা বা বাণী দেখিয়ে রাহুলকে চড়-থাপ্পড় মেরে কোরআন পড়তে পাঠিয়েছে।
এসবে রাহুল অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারপরেও একদিন খুব ভয় পেয়ে গেল। আহেদ তার কাছারি ঘরটা এক মওলানাকে মাসিক ভাড়ায় থাকার জন্য দিয়েছিল। মওলানা প্রাইমারি স্কুলের ইসলাম ধর্ম শিক্ষক। তিনি হাঁড়ি-পাতিল আর কয়েকটি কাঁথা-বালিশ নিয়ে উঠেছিলেন। সঙ্গে একটা কেরোসিনের স্টোভ ছিল। আর ছিল একটা করে টুপি-জায়নামাজ-পাঞ্জাবি-বদনা। ঘরে সস্তায় কেনা চৌকি ছিল। মওলানা সাহেব সেটাতেই ঘুমান, নামাজ পড়েন। তার আর কিছু ছিল না। বোঝাই যায় টেনেটুনে চলা লোক। ঠিকমত রান্নাবান্নার সময় পান না বলে এক কাজের মহিলা রেখেছিলেন। কিন্তু সে নিয়মিত আসে না। তখন মওলানা সাহেব নিজেই কোন রকমে আলুভর্তা, বেগুন ভর্তা বা কচুর পাতা সেদ্ধ করে তরকারি বানান। সারাদিন ক্লাশ করিয়ে রাতের বেলা তাকে এগুলো খেয়েই কাটাতে হয়। নামাজ পড়ে এই মওলানার ঘরে এসে বসে আহেদ আলী। মওলানা সাহেব তখন হয় রান্নায় ব্যস্ত থাকেন, অথবা আহেদের সামনে কোরআর-হাদিস খুলে বসেন। আহেদ এ সময় ধর্ম নিয়ে নানান গবেষণামূলক আলোচনা শুরু করেন। মওলানা সাহেব কোরআন-হাদিসের পাতা উল্টান, আর মাঝে মধ্যে ‘ঠিক বলেছেন’ বলে সায় দেন। আহেদ আলীর আলোচনার বেশিরভাগটা জুড়েই থাকে কে পাপী, কে নামাজ পড়ে না, কে বেহেস্তে যাবে আর কে যাবে না। তবে এই আলোচনায় আরেকটা বিষয় থাকে। সেটা হলো নারী। নারী জাতির চরিত্র, রূপ, আর দেহ নিয়ে যেসব আলোচনা হয়- তা রাহুলের কাছে খুবই কুৎসিত এবং যঘন্য বলে মনে হয়। বেহেস্তে একজন খাঁটি মুসলমান কতোগুলো হুর পাবে, হুরগুলোর দেহ কেমন হবে, কী পরিমান শরাব মিলবে- এসব কথাগুলোও ভাল লাগে না ওর। দুজনের আলাপের সময় মাঝে মধ্যে কান পেতে এসব শুনতে শুনতে আর শোনেনা রাহুল। কিন্তু সেদিনের আলোচনা শুনে ও খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। কাওকে কিছু বলতে পারছে না, সইতেও পারছে না। ওর ঘুম হারাম হয়ে যাবার মত অবস্থা।
আহেদ হঠাৎ প্রশ্ন করলো, ‘একজন মুসলমান কয়টা বিয়ে করতে পারে?’
মওলানা জবাব দিলেন, ‘দেশের আইন অনুযায়ী একটাই বিয়ে করতে পারে।’
- আমি দেশের আইনের কথা বলছি না। ইসলাম কি বলে?
- ইসলামে ৪টি বিয়ে জায়েজ।
- আমাদের নবী কটা বিয়ে করেছিলেন?
- ১২ কি ১৩ টা বিয়ে করেছিলেন- আমতা আমতা করে জবাব দিলেন মওলানা।
- তার মধ্যে সাবালিকা থেকে নাবালিকাও ছিল।
- হ্যাঁ, ছিল।
- আমরা কার অনুসারী? কার উম্মত?
- নবীর উম্মত।
- তাহলে নবী যা করেছেন, আমরাও তাই-ই করবো। আমরা কেন অন্যকিছু মানতে যাবো?
মওলানা সাহেব হা করে থাকলেন। আর আহেদ অন্যরকম এক তৃপ্তি নিয়ে উঠে চলে গেল। এইসব দেখে-শুনে বিচলিত রাহুল।
-------- চলবে ---------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message