শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
এক মাস কাটিয়েছিল রাহুল। বাড়ির লোকজন বড্ড ভাল ছিল। ওকে কোন কাজ করায়নি। শুধু হাটবারের দিন মালিকের সঙ্গে যেতে হয়েছে। তিনি বাজার-সদাই করে এক জায়গায় জমিয়েছেন। সেগুলো পাহারা দিতে হয়েছে। তারপর মালিকের সঙ্গে মাইল পাঁচেক হেঁটে বাড়ি ফিরতে হতো। নামাজ পড়ার ব্যাপারেও কড়াকড়ি ছিল না। ওতে থাকতে দেওয়া হয়েছিল মালিকের ছেলের সঙ্গে এক বিছানায়। সেও নামাজ পড়তো না। তাই রাহুলকে যেতে হতো না। শুধু শুক্রবারে জুম্মার নামাজটা পড়তে হতো। এছাড়া সারাদিন বনবাদারে ঘুরে বেড়ানো, মাছ ধরা, ফাঁদ পেতে পাখি শিকার, কখনও কখনও মালিকের ইয়ারগান নিয়ে তার ছেলের সঙ্গে পাখি মারা- এসব ছিল কাজ। দারুণ দিন কাটছিল। সম্ভববত এই আনন্দময় জীবনের খবর পেয়েছিল আহেদ আলী। তাই এক মাস পর এসে ওকে আবার ফিরিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।
বাড়িতে ফিরেই জানতে পারলো অনেক কীর্তির কথা। আহেদ আরেকটি বিয়ের সব আয়োজন করে ফেলেছে। ধর্মের কথায় বশিভূত রাহুলের মাও এতে সায় দিয়েছে। সুতরাং সবকিছু পাকা। এখন বিয়ে করে ঘরে তোলা বাকি। আর এসব কান্ডে আগের মতোই সহযোগী হয়েছে ভাড়াটিয়া মওলানা সাহেব। মনে মনে রাহুল ভাবলো, ওর ভাগ্য ওকে সময়মতোই ফিরিয়ে এনেছে। আর ক’টা দিন দেরি হলে কিছুই করার ছিল না। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে রাহুল আগের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। ওর কোন সাহায্যকারী নেই। কোন বুদ্ধি দেওয়ার কেউ নেই। যা করার ওকে একাই করতে হবে। মওলানাকে তাড়াতে পারলে আহেদের একটা হাত ভেঙে যাবে। ভাগ্য ভাল হলে আরও অনেক কিছু হতে পারে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাহুল একটা লাল কাগজের উপর কালো কালি দিয়ে বাম হাতে চিঠি লিখলো। যাতে কার হাতের লেখা বোঝা না যায়। বুদ্ধিটা ডিটেকটিভ বই কুয়াশা, দস্যু বাহরাম, আর দস্যু বনহুর থেকে পেয়েছিল। চিঠিতে ও লিখলো, ‘ওরে শয়তান, তুই ভেবেছিস পালিয়ে গিয়ে বেঁচে যাবি। কিন্তু না, তুই বাঁচতে পারবি না। আমাদের হাত থেকে কেও বাঁচে না। তুইও বাঁচবি না। তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে। ভাল মন্দ যা খাবার খেয়ে নে। আমরা তোকে নিয়ে যেতে আসছি।....... তবে হ্যাঁ, একটা কাজ করলে তুই আপাতত বাঁচতে পারিস। আমাদের এখন টাকা-পয়সার খুব অভাব। তুই যদি এক ঘণ্টার মধ্যে নগদ দশ হাজার টাকা দিস্, তাহলে আপাতত রক্ষা পাবি। আর যদি টাকা না দিস্, তাহলে তুই শেষ। কি করবি, ঠিক কর। যদি টাকা দিতে রাজি থাকিস, তাহলে চিঠি হাতে পাওয়ার পর তোর ঘরের দরজায় হারিকেন জ্বালিয়ে ঝুলিয়ে রাখিস। আমরা এসে টাকা নিয়ে যাবো।
মনে রাখিস্, যদি এইমত কাজ না করিস্, তাহলে তুই আর বেঁচে থাকবি না। ইতি- তোর যম-
পূর্ব বাঙলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল)। জয় সর্বহারা।’
রাহুল জানতো, মওলানার অতো টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই। তাই চিঠি পাওয়ার পর সে কী করে- সেটাই দেখার বিষয়।
মওলানা সাহেব প্রতিদিনের মতো এদিনও সন্ধ্যের আগ দিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গেল। ঠিক খানিক পরেই রাহুল আস্তে করে বের হলো। তারপর খামে ভরা চিঠিটি গোলাকার রোলের মত করে মওলানা সাহেবের দরজায় লাগিয়ে যাওয়া তালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। ফিরে এসে ও নামাজে বসে গেল।
তারপর নিজের ঘরে লাইট জ্বালিয়ে পড়তে বসলো। কিন্তু কান খাড়া করে রাখলো মওলানা সাহেবের ফিরে আসার অপেক্ষায়। ওর বুকের মধ্যে জোরে জোরে ঢিব ঢিব করছিল। না জানি কি ঘটে!
বেশ কিছুক্ষণ পর মওলানা সাহেবের দরজায় তালা খোলার শব্দ পেল। ও বুকের ঢিব ঢিব দূর করার জন্য শব্দ করে পড়তে লাগলো। দু’মিনিট না যেতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আহেদ চেচিয়ে উঠলো, ‘কে’? কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর এলো, ‘আমি’। আহেদ বুঝতে পারলো। বললো, ‘কি হয়েছে?’ দরজা থেকে আর্তনাদের মত জবাব এলো, ‘তাড়াতাড়ি আসুন’।
আহেদ হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে এগিয়ে গেল। তারপর কি হলো বুঝতে পারলো না রাহুল। কোন সাড়া শব্দ শুনতে পেলো না। অনুমান করতে পারলো, ফিসফিস করে আহেদ আর মওলানা সাহেব কথা বলছে।
খানিক পরেই রাহুল দেখলো, মওলানা সাহেব কাপড়-চোপড়ের একটা পোটলা হাতে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো। আহেদ তাকে পথ দেখাচ্ছে। তারপর মওলানা সাহেব বাড়ির পেছন দিকে লতাপাতার সীমানা প্রাচীর টপকে জঙ্গলের ভেতর দৌড়ে চলে গেল। মওলানা যেতেই আহেদ ঝড়ের গতিতে বাড়ি-ঘরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিলো। রাহুলের পড়ার ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে গলা বসিয়ে চিৎকার করার মতো করে বললো, ‘দরজা-জানালা বন্ধ কর। ঘরের লাইট বন্ধ রাখ। জ্বালাবি না। দেরি না করে শুয়ে পড়।
রাহুলের পেটের ভেতর তখন হাসি জমে বোমার মত হয়ে গেছে। পেট আর গলা ফেটে সে হাসি বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে সে হাসি চেপে রেখে আহেদের কথামত দরজা-জানালা-লাইট বন্ধ করে দিলো। ওদিকে আহেদও তার ঘরে ঢুকে সবকিছু বন্ধ করে দিলো।
পেট আর মুখ চেপে ধরে রাহুল বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর মুখের ভেতর চাদর ঢুকিয়ে খিক খিক করে হাসতে লাগলো। মুখে চাদর থাকায় হাসির শব্দ বেরুচ্ছিল না। তবে দুই পা আর শরীর উথাল-পাতাল করে দাপাদাপি করছিল। কিছুতেই থামছিল না। মুখ থেকে চাদর সরালেই হিক হিক করে হাসির শব্দ বেরিয়ে পড়ছিল। রাহুল শুয়ে শুয়ে দিব্য চোখে দেখতে পেলো, ওর মা-বোনদের নিয়ে ভয়ে আহেদ আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপছে। চোখ-কান খাড়া রেখেছে। কোথাও পাতা পড়ার শব্দ হলেও আতঙ্কে কঁকিয়ে উঠছে। যে-ই বারবার করে এসব মনে হচ্ছে, তখন হাসি ঠেকাতে পারছে না রাহুল। বালিশে মুখ চাপা দিয়ে খিক খিক করে অনবরত হাসছে আর হাসছে।
এই প্রথম দারুণ জয় রাহুলের। মওলানা সাহেব পালিয়ে গেছে। আর ওর বাবা ঘর-দরজা বন্ধ করে বন্দি জীবন বেছে নিয়েছে। সবাইকে বাইরে বেরুনো নিষেধ করে দিয়েছে। এভাবে পুরো সাত দিন ঘরবন্দি জীবন কাটলো সবার। কেউ ডাকলেও দরজা খোলা হচ্ছিল না। পরিচিত কেও বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে আহেদকে খুঁজলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আহেদ রাহুলকে বলে দিয়েছে, কেও ডাকলে যেন বলে দেয়, সে গ্রামের বাড়িতে গেছে। এখানে নেই।
সাতদিন পর উঁকি-ঝুঁকি মেরে ঘরের দরজা খুলে উঠোন পর্যন্ত বেরুনো শুরু করলো আহেদ। রান্না-বান্নার জন্য স্ত্রীকে বাধা দিচ্ছিল না। তবে নিজে খুব সাবধানে থাকতে লাগলো। আহেদের ভয়, মওলানাকে পালাতে সাহায্য করে এবং তার বাড়িতে থাকতে দিয়ে সে মহা-অপরাধী হয়ে গেছে। সে কারণে নকশালরা তাকেও হয়তো হত্যা করবে। যে কোন সময় তাকে ধরার জন্য ওরা আসতে পারে।
এদিকে গোটা সময় পর্যন্ত ঘরবন্দি রাহুল শুধু হাসে আর হাসে। কখনও বালিশে মুখ চেপে, কখনও মুখে হাত চেপে। হাসতে হাসতে ওর পেট আর গলায় খিল ধরে গেছে।
এই ঘটনার ভেতর দিয়ে আহেদের আরেকটি বিয়ে করার স্বপ্ন ভন্ডুল হয়ে গেল। কারণ যোগাযোগ রক্ষা এবং সময়মত হাজির হতে না পারায় সব বাতিল হয়ে গেছে।
---- চলবে -----
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message