শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
আহেদ আলী চেয়ারে বসে।
হাতে তসবিহ্। একটা একটা করে হিসাব গুনছিল। সময় নিয়ে দানাগুলো ছাড়ছিল। এমনিতে অনেক বয়স হয়ে গেছে।
আগেরমত শরীর চলে না। উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট হয়। দাঁড়ানো থেকে বসাও কষ্ট। মনে হয়-
এই বুঝি হুরমুড়িয়ে পড়বে। তারপর সব
হাড়গোড় ছিটিয়ে যাবে।
চলতে ফিরতে খুব সমস্যা। তাই একটা লাঠি ভড় দিতে হয়।
আহেদ হিসাব মেলাচ্ছিল। লাভ-ক্ষতির হিসাব। কিন্তু ফলাফলটা পরিস্কার হচ্ছে না। শূন্য অবস্থা থেকে সে অনেক কিছু করেছে।
ঘর-বাড়ি আগের চেয়ে অনেকটাই ভাল করেছে। মেয়েগুলোর বিয়ে দিয়েছে।
সঙ্গে নগদ টাকা-পয়সা-জমিও দিয়েছে।
যেমন বড় মেয়েকে নগদে এক
লাখ টাকা দিয়েছে।
দ্বিতীয়জনকে বসতবাড়ির দুই শতাংশ জমি, তার স্বামীকে আরও দুই শতাংশ জমি দিয়েছে। তৃতীয়জনকে
নগদ টাকায় ৩৬
শতাংশ জমি কিনে দিয়েছে। চতুর্থজনকে দিয়েছে নগদ দুই লাখ টাকা।
পঞ্চমজনকে নগদ টাকায় দুই কাঠা জমি কিনে দিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তাদের নগদ টাকাসহ নানান কিছু দিয়ে চলেছে।
আহেদ যখন এই হিসাব গুনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে যাচ্ছিল, তখন ভেতর থেকে আরেক আহেদ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো- - অ্যাই ব্যাটা আহেদ আলী, গপ্প মারার জায়গা পাস্ না?
তোর এতো টাকা এলো কোত্থেকে? তুই তো
এ টাকা আয়
করিসনি। অসৎ উপায়ে এ টাকা হাতিয়েছিস। এসব পাপের টাকা।
পাপ করে তুই বগল বাজাতে চাস্? একটু হকচকিয়ে গেল আহেদ।
ঢোক গিললো। তসবিহ্র দানা আটকে গেল। তারপর দ্রুত সামলে নিলো নিজেকে।
মিনমিন করে বললো- - পাপ করেছি, খেশারতও দিয়েছি। নামাজ পড়েছি, জাকাত দিয়েছি। মাদ্রাসার জন্য মোটা টাকা আর জমি কিনে দিয়েছি।
এতিমদের এবাদতের জন্যও মোটা অংকে জায়গা কিনে দান করেছি।
বসতবাড়ির দুই শতাংশ জায়গা পর্যন্ত দান করেছি। এখন শরীর দুর্বল, তাই পাঁচ ওয়াক্তো নামাজ পড়তে পারি না ঠিক, কিন্তু এবাদত তো করি। এর কি কোন পূণ্য নেই? ভেতরের আহেদ হি হি করে হাসলো।
তারপর বললো- - ব্যাটা জোচ্চর, পাপ করিস্ আর নামাজ পড়িস্। তুই তো একটা ভন্ড। ভন্ডামি করে আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করিস্। নামাজ পড়লেই পাপ চলে যায় না। তুই পাপ করিস্, আর নামাজ পরিস্। এ নামাজ হয়
না, তোর পাপও যায় না। তুই সবার সঙ্গে প্রতারণা করে এতোদূর এসেছিস। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিস, স্ত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছিস, গোটা পরিবারের সঙ্গে প্রতারণা করেছিস, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছিস, সমাজের সঙ্গে প্রতারণা করেছিস, দেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছিস। খোদ আল্লাহর সঙ্গেও তুই প্রতারণা করছিস। তোর মত মহাপাপী আর নেই।
আবার খানিকটা চুপসে গেল আহেদ। তারপর একটু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।
বললো- - বেশ করেছি। যা করেছি ঠিক করেছি। এসব না
করলে কি টিকতো পারতাম?- আবার হাসলো নেপথ্যের আহেদ। বললো- - তুই-ই তো আসল নাস্তিক।
পাপ, আল্লাহ- এসব বিশ্বাস করলে কি
তুই কখনও অপকর্ম করতিস্? করতিস্ না। আরও ক্ষিপ্ত হলো আহেদ।
বললো- - বিশ্বাস নিয়ে তুই বলার কে রে? বিশ্বাস করে চলতে গেলে মরে ভুত হয়ে যেতে হতো। কোন্ ব্যাটা আছে যে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে- পাপ করে আর নামাজ পড়ে না। পাপের জন্যই তো নামাজ। পাপ না করলে নামাজের কি
দরকার আছে? নাই। আমি পাপ করি, তাই নামাজ পড়ি।
৯৮ জনই তাই করে। তাই বলে কি নিজেদের কেউ নাস্তিক মনে করে? করে না। বরং আমরা তাদেরই নাস্তিক বলি- যারা আমাদের বিরোধিতা করে, যারা আমাদের ভন্ড বলে- তারাই নাস্তিক। - হুঁ, গোমড় ফাক করে দিলেই নাস্তিক! এই জন্যই তো
তুই তোর বড়
ছেলেকে নাস্তিক বলিস।
কিন্তু আসল নাস্তিক তো তুই। তারপর অনেকক্ষণ কথা নেই।
আহেদও চুপ, নেপথ্যও চুপ। নিজেকে একটু ঝাড়া দিলো আহেদ।
বাজে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলো। তারপর আবার তসবিহ্ টিপতে শুরু করলো।
ভাবলো, সত্যিই কি
সে পাপী। নাহ্। সে যদি পাপী হয়,
তাহলে তাবৎ মোল্লা-মুসুল্লিদের বেশিরভাগই পাপী। কারণ তারা এমন করেই চলে। তাদের যদি অন্য গুন থাকতো- তাহলে তারা মোল্লাগিরি করতো না। মোল্লাগিরি না করলে তারা ভাত-কাপড়ে মরতো। মরতো, আর ভুত হয়ে যেতো।
নবিজি এই একটা পথটা দেখিয়ে দিয়েছেন বলেই না
ধর্মটা আছে। নাহলে ধর্ম থাকতো না। ধর্ম আছে বলেই এর মহাত্ম আছে। মহাত্ম মানে ব্যবসা আছে, আয়-রোজগার আর বেঁচে থাকা আছে।
তাই এইভাবে আয়-রোজগারে পাপ নাই।
পাপ নিয়ে চলতে গেলে বাঁচার পথ
নাই। ধ্বংস, ধ্বংস অনিবার্য। আমি ধ্বংস চাইনি, চাই না। তাই পাপ হোক, আর অন্য যাই হোক- যা করা উচিৎ তাই করেছি। এরজন্য শাস্তি হলে খোদাই দায়ি। কেন তিনি আমাদের অন্য পথ করে দেননি? কেন তিনি ভন্ডামি পথের সুযোগ দিয়ে রেখেছেন? রেখেছেন বলেই- করি। এরজন্য শাস্তি হলে আমার একার হবে না, তাবৎ মৌলভি আর মোল্লাদের শাস্তি হবে।
ওই যে একটা গান আছে না-
‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া এত যত্নে গড়াইয়াছেন সাঁই ছায়া বাজী পুতুল রূপে বানাইয়া মানুষ যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ? যেমনি নাচাও তেমনি নাচি.... তুমি খাওয়াইলে আমি খাই আল্লাহ। তুমি বেস্ত তুমি দোজখ তুমি ভাল মন্দ তুমি ফুল তুমি ফল
তুমি তাতে গন্ধ আমার মনে এই আনন্দ। কেবল আল্লাহ তোমায় চাই আমি.... তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর সর্প হইয়া দংশন কর
ওঝা হইয়া ঝাড় তুমি বাঁচাও তুমি মার তুমি বীনে কেহ নাই আল্লাহ, তুমি বীনে কেহ নাই।’ তাই আমি পাপের ভয়
করি না। হুকুমদার যেমন করায়, তেমন করি। আমার কোন দোষ নাই। সব দায় তার.... -------- চলবে -------