সিঙ্গাপুরের মেট্রোরেলে
স্মার্ট দেশ সিঙ্গাপুর
- ইয়াসমিন হোসেন
হতবাক করা দেশ। রাস্তাঘাটে কোন ট্রাফিক নেই, পুলিশ নেই। কিন্তু সব চলছে চুলচেরা নিয়ম মাফিক। ফাঁকা ঝকঝকে রাজপথগুলোয় হলুদ সিগন্যাল বাতি জ্বলে উঠতেই থেমে পড়ছে সব ধরণের যানবাহন। হলুদ থেকে থেকে লাল, তারপর আবার হলুদ হয়ে সবুজ বাতি না জ্বলা পর্যন্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকছে। অথচ দিব্বি চলে গেলে কে ধরে! ট্রাফিক তো নেই। কিন্তু কেও সেটা করে না।
ট্রাফিক নেই- কারণ এখানে সবকিছুই স্মার্ট এবং কম্পিউটারাইজড। গোটা নগরটাই এরকম। কোথাও কোন অনিয়ম করলে কম্পিউটার ধরে ফেলবে, এবং সিগন্যাল পৌছে যাবে পুলিশের কাছে। তখন কালবিলম্ব না করে পুলিশ ধরে ফেলবে অনিয়ম করা- সে যে কেউ হোক না কেন। সুতরাং এখানে একচুল অনিয়মের সুযোগ নেই, মনোজগতেও নেই।
এখানে লোকজন যেখানে সেখানে রাস্তা পারাপার হন না। এরজন্য তাদেরকে যেতে হয় রাস্তার নির্ধারিত সিগন্যাল পোস্টের নিচে। সেখানে পোস্টের সঙ্গে থাকা বোতাম চাপতে হয়। তখন পোস্টের মাথায় থাকা লাল বাতি জ্বলে ওঠে। পুরো তিন মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। তারপর হলুদ বাতি হয়ে সবুজ বাতি জ্বলে। এসময় তিন মিনিটের জন্য রাস্তা পারের সুযোগ দেওয়া হয়। রাস্তা যতোই ফাঁকা থাকুক, এই নিয়ম মেনে পার হতে হবে। আর রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী দ্রুতগামী যানবাহনগুলো ওই ল্যাম্বপোস্ট বরাবর এপার-ওপার রাস্তার মার্ক করা ক্রসিং অংশে (পারাপারকারীদের জন্য সবুজ বাতি জ্বলা পর্যন্ত) অপেক্ষা করতে থাকবে। সুতরাং দুর্ঘটনার তিল পরিমাণ আশঙ্কা নেই। নেই, কারণ এই দেশে কোন একটি মানুষ নিয়ম বা আইন ভঙ্গ করেন না।
চোখ ঝলকানো মার্কেটগুলোর বেশিরভাগ দোকানপাট বা শো-রুমে ঢুকে দেখেছি, বিক্রির জিনিসপত্র সারি সারি সাজানো, তাতে দাম লেখা আছে, কিন্তু রুম ফাঁকা। কোন দোকানদার নেই। তার বদলে আছে জিনিসপত্রের সারির সঙ্গে একটা করে স্মার্ট মেশিন। ওই মেশিনই দোকানদার। জিনিস পছন্দ করে, দাম দেখে তা মেশিনে ঢুকিয়ে দিলেই পেইড লেখা স্লিপ বেরিয়ে আসছে। কেনা হয়ে গেল। সবাই এই নিয়মেই কোনাকাটা করছেন। স্মার্টকার্ড মেশিনে ঢোকাচ্ছেন, স্লিপ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। কেউ ফাঁকি দিচ্ছেন না। দিলে ধরে ফেলার কী স্মার্ট সিস্টেম আছে- তা অবশ্য জানতে পারিনি।
দেশটির রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট, বাজার ইত্যাদি এতো পরিস্কার এবং চোখ ধাঁধানো যে- আমরা (আমি এবং স্বামী) যে কয়দিন ছিলাম সে কয়দিন বহু হেঁটেও জুতোর তলায় তিল পরিমাণ ধুলো-বালি-ময়লা খুঁজে পাইনি। কেনা জুতা যেমন পরে গেছি, অনবরত ঘোরােেফরা করে দিব্বি সেই রকম নিয়ে দেশের পথে রওনা হয়েছি।
এখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, মিথ্যা কথা, প্রতারণা, ফাঁকি দেওয়া কাকে বলে- স্থানীয়দের কেউ তা জানেন না। জানেন না কারণ- এগুলোর কিছুই এখানে নেই। অনেক আগে এদেশ থেকে এগুলো দূর করে দেওয়া হয়েছে। দেখলাম, এখানকার নারী বা পুরুষরা নামমাত্র পোশাক-আশাক পড়েন। স্বল্প পোশাকের নারীরা একা একা রাত একটা, দুইটা, তিনটা বা যে কোন সময় রাজপথ, গলিপথ, পার্ক ইত্যাদি জায়গায় ঘুরে বেড়ান না কেন- কোথাও কোন বিপদে, মানে আমাদের দেশের মত গু-া-বদমায়েশের হাতে পড়া বা ছিনতাইকারীর হাতে পড়ার সম্ভাবনার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারবেন না। কারণ গোটা নগরীই শতভাগ সর্বসময় নিরাপদ। সর্বত্রই গোপনভাবে রয়েছে সিসি ক্যামেরা, যার মাধ্যমে নজর রাখছেন দায়িত্বশীলরা।
তারপরেও পুলিশ কিন্তু আছে। তবে তারা কোথায় আছে, কেও তা দেখতে পান না। রাত-বিরাতে ফাঁকা রাস্তায় একা চলতে গিয়ে যদি আপনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যান, দেখবেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আপনার কাছে পৌছে গেছে সাহায্যকারী একদল পুলিশ। তারা আপনাকে সেবা করবে, অথবা প্রয়োজন হলে তারাই গাড়িতে করে হাসপাতালে পৌছে দেবে। এভাবেই এটা স্মার্ট দেশ।
এই দেশের মানুষগুলো একে অন্যের প্রতি, বিশেষ করে পর্যটকদের বিষয়ে এতোটাই সহযোগিতামূলক- যা আমাদের বাঙালিদের অতীত দিনে আন্তরিকতাকেও হার মানায়। আমরা যে কোন প্রয়োজনে বা সাহায্যের জন্য তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তারা (তিনি পুলিশ, পথিক, চাকরিজীবী, অফিসার যেই হোন না কেন) আমাদেরকে নিজের আত্মীয়র মত আন্তরিকতা, সহযোগিতা আর ভালবাসা দিয়ে ভূমিকা রেখেছেন। বলার অপেক্ষাই রাখে না, দেশটা সত্যিই স্বর্গপুরী। রূপে, গুণে, ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে সবকিছুতে এমন। এখানে এক রাস্তা ছাড়া সবকিছু; মানে দোকানপাট, বাড়িঘর, বসতি, অফিস, আদালত সবকিছুই এয়ারকন্ডিশনড এবং স্মার্ট সিস্টেমের আওতাভূক্ত। দেশটা গরমের, তাই এয়ারকন্ডিশনিংয়ের এমন ব্যবস্থা।
এখানে শুধু মেট্রো ট্রেনে চড়েই দিনভর সারাদেশ ঘোরা যায়। খরচ খুব কম। এক স্টেশনে যেতে যে ভাড়া, সেই ভাড়ায় (ট্রেন থেকে না নামলে) সারাদিন ঘোরা যায়। এখানবার বাস, ট্যাক্সি ইত্যাদি সব চলে স্মার্ট কার্ডে। এখানে আমাদের দেশেরমত মটর সাইকেল, রিকশা, সিএনজি, ঠেলা ইত্যাদির স্থান নেই। যে কারণে রাস্তাঘাট সবসময় ফাঁকা এবং জটমুক্ত।
হ্যাঁ, আমরা মানে আমি এবং আমার স্বামী ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। এক সপ্তাহের বেশিদিন সেখানে ছিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message