শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
দেশটা স্বাধীন হয়ে গেল। পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পন করলো। তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস, এবং জামায়াত-মুসলিম লীগ ও নকশালের সবাই গাঢাকা দিলো।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরিবার নিয়ে বাড়িতে ফিরলো আহেদ। ভিতরে ভিতরে খুব ভয়। না জানি দালালির জন্য মার খেতে হয়! তাই আপাতত বাড়িতে কিছুদিন থাকলো। ভাড়াটিয়া মওলানা গ্রামে পালিয়ে গেছে। পাশের বাড়ির রহমানরা বেশ দেরি করে ফিরলো। তার দুই বাড়ির ভার ছিল আহেদের উপর। যেহেতু সে শহরে থাকছিল, সেজন্য রহমান তাকে বাড়ির জিনিসপত্র দেখে রাখতে বলেছিল। লুটপাট থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন মনে করলে সবকিছু নিজের বাড়িতে নিয়ে হেফাজতে রাখার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল। আহেদ সেইমতো বাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র নিজের বাড়িতে জমিয়েছিল। চেয়ার-টেবিল, খাট, হাড়ি-পাতিলসহ সবকিছুই তার জিম্মায় নিয়েছিল। আশপাশের সব বাড়িতে রাজাকাররা হানা দিয়ে লুটপাট করলেও আহেদের এখানে আসেনি। তাই সব মালামালই রক্ষা পেয়েছিল।
রহমানরা যখর শূন্য বাড়িতে ফিরলো তখন আহেদ খুব একটা কাছে ঘেষলো না। শেষ পর্যন্ত রহমান বাড়িতে ঢুকে আহেদের কাছে থাকা জিনিসপত্র ফেরত চাইলো। কিন্তু বেঁকে বসলো আহেদ। বললো, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব রক্ষা করেছি। এগুলো ফেরত দেবো না। এগুলো তো লুট হয়ে যেতো।’
রহমান বুঝতে পারলো আহেদের উদ্দেশ্য। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে থেকে রহমান ফিরে গেল। আহেদের কাছে থাকা তেমন কোন জিনিসই আর ফেরত পেলো না সে। এই থেকে সম্পর্ক কমিয়ে দিলো রহমান। আহেদের জায়গায় যে গ্যারেজ বানিয়েছিল, তা তুলে নিল কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। নষ্ট গাড়িগুলো নিজের জায়গায় নিয়ে রাখলো। আহেদ-রহমানের সুসম্পর্কটার এখানেই ইতি ঘটলো।
আহেদ ভাবছিল সে দারুণভাবে লাভবান হলো। বিনা পয়সায় বহু জিনিসপত্র পেয়ে গেল। লাভ পেয়ে সে গ্যারেজ চলে যাওয়ার ক্ষতিটা ভুলে গেল।
দেশ স্বাধীন হওয়াটা আহেদের জন্য নানান দিক থেকে অশুভ মনে হলো। কারণ চারদিক থেকে পরাজয় ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো। শহরের বাইরে যে জমিগুলো রেখেছিল সেগুলো ছিল সুচতুর কৌশল করা। নামমাত্র টাকায় বায়না করেছিল। শর্ত দিয়েছিল, আস্তে আস্তে দাম পরিশোধ করবে। জমিতে আবাদ করবে, তা থেকে এটা দেবে। স্বাধীনতার আগে এভাবেই নামমাত্র টাকায় হাতে পাওয়া জমিগুলি ভোগ করছিল সে। শুধু ভোগই করেছে, কিন্তু কোন দাম পরিশোধ করেনি। তাই শর্ত অনুযায়ী সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। টাকা পরিশোধ না করায় এর আসল মালিকরা চাপ দিলো। তবুও টাকা পরিশোধ করলো না আহেদ। কারণ এই টাকার চেয়ে সে অনেক বেশি লাভ করেছিল জমি বর্গা দিয়ে। এই অবস্থায় জমিগুলি হাতছাড়া হয়ে গেল। ঘরে ফসল আসা বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে চাপে পড়ে যাবে- সে হিসাবটা কখনও করেনি আহেদ।
তাই হিসাবটার মাশুল তুলতে শুরু করলো পরিবারের উপর। যতোটুকু সুযোগ-সুবিধা চালু রেখেছিল, তা বন্ধ করে দিলো। চাল-ডাল-তেলসহ বাজার-সদাই একরকম বাতিল করে দিলো। পোশাক-আশাক তো আগেই নামকা ওয়াস্তে ছিল, এখন সেটাও বন্ধ করলে। পরিবারের উপর নামিয়ে দিলো নির্যাতনের স্টিমরোলার। অমানুসিকভাবে মারপিট করতে শুরু করলো স্ত্রীর উপর। আহেদের এক কথা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার ছেড়ে চলে যাক স্ত্রী। সে একা থাকতে চায়।
এরমধ্যে সেই বৈঠকখানার মওলানা এসে হাজির হলো। আগের মতোই থাকা শুরু করলো। আর আহেদের জন্য সুযোগ এনে দিলো আগের মতো ‘ধর্ম গবেষণা’ করার। গবেষণার বিষয় আর কিছুই নয়- নারীদের নিয়ে কুৎসিত আলাপ-আলোচনা, আর কে ইসলামবিরোধী সেই ফতোয়া তৈরি করা।
------------ চলবে -----------