দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : পাঁচ)
ইয়াসমিন হোসেন
আমাদের জিপ দ্রæত বেগে ঘন ঘন ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে মোড় ঘুরছে আর উপরে উঠছে। ডান পাশ দিয়ে সামনে থেকে আসা জিপ-ট্রাক স্যাৎ স্যাৎ করে পাশকাটিয়ে চলে যাচ্ছে। দেখেই মনে হয়Ñ এই বুঝি টোকা লাগলো আর জিপ ছিটকে চলে গেল রাস্তা থেকে পাহাড়ের অতলতলে।
মোড় ঘোরার সময় আমাদের চালক বা সামনে থেকে আসা জিপ-ট্রাকের চালকদের কোন রকম চিন্তিতই দেখাচ্ছিল না। আর কী দক্ষতার সঙ্গেই-না তারা এতো জোরে গাড়ি চালাচ্ছেন, ব্যালেন্স ঠিক রাখছেন, অন্য গাড়িকে পাশ কাটানোর সময় একেবারে রাস্তার কিনার ঘেসে চাকা চালিয়ে যাচ্ছেন। গাড়ির গিয়ারও তো হঠাৎ নষ্ট হয়ে যেতে পারে, আর তখন হারিয়ে যেতে পারে সব ব্যালেন্স, ঘটতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কিন্তু কিছুই ঘটছে না, চালকের মুখ বলে দিচ্ছে এসব কখনও ঘটেনি, ঘটবেও না। কী অদ্ভুৎ! অথচ আমাদের দেশে যেসব যানবাহন রাস্তায় চলে তা এমনিতেই ব্রেক ফেল করে, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। কিংবা চালক লাগিয়ে দেন আরেক গাড়িতে ধাক্কা, ঘটান অনবরত দুর্ঘটানা। এই পাহাড়ি এলাকায় তাদেরকে ছেড়ে দিলে জ্ঞান হারিয়েই মারা যাবেন, কিংবা তাদের যান ব্রেক ফেল করে পাহাড় থেকে নিচে উধাও হয়ে যাবে। এ কারণে এখানকার এইসব চালকদের শুধু চালক বললে মহাভুল হবে। এরা চালক নয়, যেন অন্য গ্রহের বিস্ময় মানুষ। এদের গাড়ির ইঞ্জিনও যেন বিস্ময় ইঞ্জিন।
উপরে ওঠার সময় সবচেয়ে বিপদজনক মোড়গুলোর কোনায় বড় আকারের আয়না লাগানো দেখতে পাচ্ছিলাম। মোড় নেয়ার সময় ওগুলো দিয়ে সড়কের আরেক পাশের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। দূরে গাড়ি থাকলে সেগুলো পরিস্কার চোখে পড়ছিল। বুকের ভেতর ধুক ধুক করলেও ডানে-বামে তাকাচ্ছিলাম, আর ভাবছিলাম আমরা কখনও দুর্ঘটনায় পড়বো না। আর পড়লেও দু:খ নেই। একেবারে হারিয়ে যাবো। তার আগে তো বিস্ময়কর পাহাড়, আর পাহাড়ের ঢাল জুড়ে পাহাড়ি জনপদসহ স্বপ্নীল প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে ফেলেছি। এটাই তৃপ্তি, এটাই স্বার্থকতা। একদিন না একদিন তো হারিয়ে যেতেই হবে, সব দেখে যাওয়া কী কম সৌভাগ্যের ব্যাপার! আমরা এখন সেই সৌভাগ্যেরই সাগরে। সুতরাং কোন দু:খ নেই, কোন চিন্তা নেই, নেই কোন আফসোস।
আমাদের দেশে হাইওয়েতে চলার সময় যেমন ফাঁকা রাস্তার ধারে ছোট ছোট হাট-বাজার, দোকানপাট বা বসতি দেখতে পাই, পাহাড়ে ওঠার সময়ও সেরকম দেখতে পাচ্ছিলাম। কোন কোন মোড়ে চায়ের দোকান, ক্যান্টিন বা বাজারঘাট করার জায়গা গড়ে উঠেছে। রাস্তার ধারে পাকা বাড়িঘরও চোখে পড়ছে। এই দুপুর বেলায় কোন কোন বাড়িঘরের নেপালী পোশাক পড়া নারীরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অলস দৃষ্টিতে আমাদের যাওয়া দেখছিল। অনেক জায়গায় ফাকা রাস্তার ওপর স্কুলের ড্রেস পড়া ছেলে মেয়েদের চলাচল করতে দেখছিলাম।
এভাবে দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে থেমে পড়লো জিপ। সামনে বেশ কতগুলো ট্রাক-জিপ এলোমেলে দাঁড়িয়ে রাস্তা আটকে রেখেছে। আমাদের জিপের সামনে একটি ট্রাক দাঁড়ানো। ওর চালক নেমে গেছে পাশে কোথায়ও। এতেই লেগে গেছে জট। বেরুবার রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। তবে দেখলাম এ নিয়ে কারও কোন উত্তেজনা-চেচামেচি নেই, আমাদের দেশে সাধারণত তাই-ই হয়। গালাগালি-মারামারি পর্যন্ত শুরু হয়। কিন্তু এখানে আটকেপড়া সব জিপ ও ট্রাকের চালকরা নিশ্চিুপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। দেখলাম কিছু সময় পর চালক এসে সামনের ট্রাকটি সরিয়ে নিলো। তখন অন্য গাড়ির চালকরা মৃদু প্রশ্নবোধক চাহনি চেয়ে যার যার মতো পথ ধরলেন। আমাদের জিপও আগের মতোই ছুটলো। প্রায় দুই ঘণ্টা পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে একেবারে চুড়ায় উঠতে হবে। সেখানেই দার্জিলিং শহর। যদিও ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, এই চুড়ার উপরে রয়েছে আরও উঁচুতে অনেকগুলো চুড়া। ওসব জায়গায় এখনও বসতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।
যতোই এগুচ্ছিলাম ততোই অবাক হচ্ছিলাম। কখনও আমাদের বামে পাহাড়ের অতলতল, কখনও ডানে অতলতল দেখতে পাচ্ছিলাম। জিপ ডানে বামে মোড় ঘোরার কারণে বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যপট। ওইসব অতলতল জুড়ে দেখতে পাচ্ছিলাম ঘনঘন দালান-কোঠা-বাড়ি-ঘর-বসতি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়ে তোলা হয়েছে হাজার হাজার বাড়ি-ঘর-ভবন, এইসব ভবনের সারি চলে গেছে অতলতলের দৃষ্টিসীমার বাইরে পর্যন্ত। বড় থেকে ছোট হতে থাকা এসব ভবন ছবির মতো রংবেরংয়ের মনে হচ্ছিল। শুধু ভবন নয় যাতায়াতের পাকা সড়ক এবং রেললাইন পর্যন্ত রয়েছে অতলতল পর্যন্ত। কীভাবে, কী নিখুঁৎ পরিকল্পনায় এবং কী অকল্পনীয় নির্মাণশৈলীতে এসব গড়া হয়েছেÑ মাথায়ই আসছিল না। কতোদিন লেগেছে এই কল্পনাতীত সাম্রাজ্য গড়তে? এমন মজবুত এবং সুপরিকল্পিতভাবে এসব গড়া হয়েছে যে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ভেবে বিস্ময়ে বিমূঢ় হলাম এই কারণে যেÑ এতো বিশাল এলাকা জুড়ে এভাবে বিনির্মাণ সত্যিই বিজ্ঞানের মহা আবিস্কারকেও হার মানায়। সত্যিই মানুষ যে সব পারে, মানুষই যে সকল সৃষ্টির বড় স্রষ্টা, মহাকারিগরÑ এখানে না এলে সেটা কখনও ধারণা করতে পারতাম না। কখনও কখনও আমাদের সড়ক পথের পাশ দিয়ে রেললাইন দেখতে পাচ্ছিলাম। কীভাবে যে প্রায় ৭ হাজার ফুট নিচে থেকে রেলগাড়ি পাহাড়ের চারপাশ ঘুরতে ঘুরতে চূড়ায় চলে আসে!
সামনের দিক থেকে একটা রেলগাড়ি দেখতেও পেলাম। সেটা দ্রæত পাশ কাটিয়ে চলে গেল পাহাড়ের আরেকদিকে। লক্ষ্য করলাম এই রেলগাড়ি অবশ্য আমাদের দেশের মতো অনেকগুলো বগি নিয়ে রেল নয়। ৩ থেকে ৫/৭টা বগি নিয়ে এগুলো চলে। সবমিলিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেসে কী অসাধারণ জীবন ব্যবস্থাপনাই না গড়ে তোলা হয়েছে! বিস্ময়ে বিমূঢ় হবার মতোই।
আমরা বোধ হয় গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। কারণ এখন আর ফাকা পাহাড় চোখে পড়ছে না। দু’পাশের পাহাড়ের গা বেয়ে দেখা যাচ্ছে অসখ্য বাড়ি-ঘর-দালান-কোঠা। দেখা যাচ্ছে অফিস-প্রতিষ্ঠান-স্কুল-কলেজ। এগুলোর অনেকগুলোই বহুতল। যতো এগুচ্ছি ততো বাড়ছে ভবনের সংখ্যা। আমাদের জিপের যাত্রাপথ এরপরেও উপরের দিকে ছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম উপরের দিকে উঠে যাওয়া সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া চলার পথ। জিপ সাঁ সাঁ করে টপকে যাচ্ছিল দু’পাশের বাড়ি-ঘর-জনপদ। সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারছিলাম আমরা এসে গেছি। বেশ শীত লাগছে। তবে হাতের কাছে রাখা সোয়েটার এখনও গায়ে চড়াইনি। হয়তো উত্তেজনায় সেরকম শীত লাগেনি। তাছাড়া গাড়ির ভেতর কোথা থেকে যেন গরম বাতাস সরবরাহ হচ্ছিল। হয়তো গরম ইঞ্জিনের ভাপ ঢুকছিল ভেতরে। এজন্য প্রচন্ড শীত টের পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণের ভেতরই পথের দু’ধারের দৃশ্য বলে দিতে লাগলো আমরা মূল শহরে ঢুকে পড়েছি। বসবাসের বাড়ি-ঘরের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছিল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যেমন দোকানপাট, হোটেল, অফিস ইত্যাদি। পথে নারী-পুরুষের বিড়াট একটি শোভাযাত্রাও দেখলাম এক ধরণের পতাকা হাতে। প্রাইভেট কারও চোখে পড়ছিল। লোকজনের কোলাহলও বেড়ে গিয়েছিল।
কয়েকটি বাঁক ঘুরেই আচমকা থেমে পড়লো জিপ। চালক নেমে পড়লেন। অন্য যাত্রীরাও নামতে লাগলেন। চালককে বলতেই উত্তর দিলেন, ইয়ে দার্জিলিং স্যার।
-------