কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ‘সমুদ্র বিলাস’-এর সামনে |
বালুকা ভুমিতে হেঁটে বেড়ানো |
প্রবাল দ্বীপে |
সেন্টমার্টিনের প্রকৃতিক দৃশ্য |
সেন্টমার্টিন জাহাজ ঘাটের সামনে লেখক |
জাহাজের ডেকে আমরা |
নৈসর্গের দ্বীপ সেন্টমার্টিন
- ইয়াসমিন হোসেন
গভীর সমুদ্রে কী করে আস্ত একটা ভুখন্ড উঠে দাঁড়ালো, আর সেই ভূখন্ডে কী করেই'বা গাছপালা-জনবসতি গড়ে উঠলো- তা নিয়ে কৌতুহলের অন্ত ছিল না। আর সেই কৌতুহলের জায়গাটা খোদ বাংলাদেশে- ভাবতে গেলেই রোমাঞ্চিত হতে হয়। তবে ভাবনার পাট চুকিয়ে যখন কল্পনাকে হতবাক করে সেই কৌতুহলের পথে স্বশরীরে পা বাড়িয়েছি- তখন আনন্দের সীমা ছিল না। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি, না জেগে স্বপ্ন দেখছি- তা নিয়েও মগজে তুমুল বিতর্ক চলছিল। যাই হোক-এটা যে স্বপ্ন নয়, বাস্তব- সেটা মানতেই হচ্ছিল। আমি, আমার স্বামী, আর এক বন্ধুর পরিবার মিলে রওনা হয়েছিলাম।
এটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা। অক্টোবর মাস। চমৎকার আবহাওয়া। না গরম না শীত। ভ্রমণের একেবারে উপযুক্ত সময়। আমরা রাতে কক্সবাজারের এক হোটেলে কাটিয়ে খুব ভোর বেলা রওনা হয়েছিলাম। মিনি সাইজের বাসটি টেকনাফের উদ্দেশে ছুটেছিল উঁচুনিচু পাহাড় মাড়িয়ে। বনজঙ্গলে ভরা নির্জন পথ দিয়ে ছুুটতে যে কী মজা- তা বলে বোঝাবার নয়। ঘণ্টা খানেকের বেশি সময় তো লেগেছিলই। ঘাটে পৌছার আগেই স্বামীর স্থানীয় বন্ধু নূরুল হক (সাংবাদিক) জাহাজের টিকেট ম্যানেজ করে অপেক্ষা করছিল। কাছেই সমুদ্র্রের পাড়ে জাহাজ দাঁড়ানো।
জাহাজ ঘাটটি আসলে সমুদ্র থেকে লিঙ্ক হয়ে নাফ নদীর অংশ হয়ে আসা একটা জায়গায়। এতে সেরকম ঢেউ ছিল না। তবে জাহাজ দাঁড়ানো ছিল পাড় থেকে বেশ দূরে। তাতে উঠতে হবে লম্বা সাঁকো পেরিয়ে।
আমরা ধুমধাম নাস্তার কাজ শেষ করার পর ওই সাঁকো পেরিয়ে জাহাজে উঠলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত নিরাপত্তা রক্ষীরা নজরদারি করে জাহাজের ডেকে নামাচ্ছিল। কেবিনে অবস্থান নেওয়ার পর সমূদ্র দেখার পালা।
জাহাজ ছাড়ার পর আমরা নাফ নদীতে। জাহাজ চলছে মাঝ বরাবর। ডানে বাংলাদেশ, বামে মিয়ানমার। নীল জল আর ঢেউ মাড়িয়ে এগুচ্ছে। আমাদের মতো অনেকেই রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। মাঝে মাঝে ইশারায় দূরে মিয়ানমারের ছোট্ট ছোট্ট বর্ডারগার্ড ছাউনিগুলো দেখাচ্ছে। স্বামীর গলায় মুভি ক্যামেরা। আর বন্ধুর এক সহযোগির কাধে টিভি ক্যামেরা। আমরা চারপাশের দৃশ্য ধারণ করছি। জাহাজে দেশি-বিদেশি অনেক যাত্রী। সবাই প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দেখতে চলেছেন।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ নাফ নদী ছাড়িয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করলো। বড় বড় ঢেউ। জাহাজ দুলছে। দুপাশের পাহাড়শ্রেণী সরে যাচ্ছে। ক্রমশ ভারী গর্জন জোড়ালো হয়ে উঠছে। বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেবার মতো। আবহাওয়া চমৎকার, তারপরেও বিশাল বিশাল ঢেউ হৃৎকম্পন তৈরি করছিল। অথচ মানুষের দুঃসাহস দেখে অবাক হতে হয়। আশপাশে ছোট ছোট ট্রলার ঢেউয়ের ভেতর হাবুডুবু খাওয়ার মতো করে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে। যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিনের দিকে চলেছে ডিঙ্গি নৌকার মতো ট্রলার। এ দুঃসাহসের প্রশংসা না করে পারা যায় না।
কিছু সময় পরেই টেকনাফের পুরো তটভ‚মি হারিয়ে গেল। জাহাজসহ আমরা সমূদ্রের ভেতর। টেকনাফ উপক‚ল থেকে দূরে। সত্যিই তটভ‚মি থেকে এতো দূরে একেবারে গভীর সমূদ্রের মাঝে আমাদের দেশের দর্শনীয় দ্বীপভূমি থাকতে পারে- একটু মাথা না ঘামালে মহাত্ম অনুভব করা যায় না।
জাহাজ এগুচ্ছে। চারদিকে সমুদ্র আর সমুদ্র। যদি কোন অঘটন ঘটে, তাহলে জাহাজ মুহূর্তেই তলিয়ে যাবে অথৈ সাগরে। আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের উপর জাহাজ বিপদজনকভাবে দুলতে থাকায়, আর সেইসঙ্গে সমুদ্রের গর্জনে সবাইকেই ভড়কে যেতে হচ্ছিল। জাহাজের সবাই সহসা জড়োসড়ো আর নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন। স্বামী অবশ্য ঘাড়ে হাত রাখলো। তাতে সাহস বাড়লো। পাশে এক টিনএজকে আস্তে করে একজন বললো, ‘কী রে! ভিডিও করা হয়ে গেল?’ মেয়েটি জবাব দিলো, হ্যাঁ মামা। আপাতত শেষ।’ একটু বিরতি দিয়ে মেয়েটি আবার বললো, ‘আচ্ছা মামা, জাহাজে যুদ্ধের মতো অবস্থা কেন? আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন কেন?’ লোকটা ফিসফিসিয়ে জবাব দিলো, ‘ওরা কমান্ডো ফোর্স। আমরা যে জায়গা দিয়ে চলছি, এটা খুব একটা নিরাপদ নয়। কারণ মিয়ানমারের সীমান্ত সেনারা প্রায়ই আমাদের জাহাজে হামলা চালানোর চেষ্টা করে, আচমকা সামরিক বোট নিয়ে চড়াও হয়। তাছাড়া এই রুটটা স্মাগলিং, জলদস্যুতা আর মানব পাচারের কেন্দ্রবিন্দু। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। তাই নিরাপত্তার জন্য এ ব্যবস্থা।’ আমার স্বামীও বলছিল, ‘গোটা অঞ্চলটা নানা কারণে খুব জটিল। এখানে আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা রয়েছে। তাছাড়া গোটা অঞ্চল জুড়েই তো মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের নেটওয়ার্ক। এমনকি যে জাহাজ বা ট্রলারগুলো টেকনাফ টু সেন্টমার্টিন যাতায়াত করে- বলা যায় তার সবগুলোরই মালিক যুদ্ধাপরাধীরা। গোটা এলাকাজুড়ে ওদের কারবার।’ বিরবির করে জবাব দিলাম, ‘ভাল রকম জটিল অবস্থা।
টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার সাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ পৌঁছালো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। বেশ লম্বা লেনের মতো সাঁকোর মাথায় যাত্রীদের নামানো হলো। এরপর সবাইকে পায়ে হেঁটে দ্বীপভুমিতে পা দিতে হবে। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৮ কিলোমিটার লম্বা, আর আধা কিলোমিটার প্রস্থের মোট ১৬ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই ভূমিতে জনসংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। চলাচলের একমাত্র মাধ্যম রিকশা ভ্যান। ঘড়িতে বাজে প্রায় ১১টা। লাঞ্চের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে আছে। আধা ঘণ্টার মধ্যে হাল্কা নাস্তা করেই আমরা ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম।
টেকনাফ বা কক্সবাজার থেকে এখানে আবহাওয়ার তাপমাত্রা খানিকটা কম। আছে প্রবল বাতাস, যা মনকে প্রফূল্ল করার জন্য যথেষ্ট। বেড়ানোর জন্য উত্তরে সেন্টমার্টিনের প্রধান তটভূমি ছাড়াও রয়েছে নামকরণ করা নারিকেল জিঞ্জিরা, দক্ষিণে নিঝুম দ্বীপ, ছেঁড়া দ্বীপ এবং দারুচিনি দ্বীপ। সাগর ২৪ ঘণ্টায় দুই দফা জোয়ার-ভাটায় পড়ে। জোয়ারের সময় ছেঁড়া দ্বীপের প্রায় সবটাই তলিয়ে যায়। জোয়ার কেটে গেলে জেগে উঠে। ভাটার সময় মোটেও সাগরে থাকতে নেই। তাহলে সহসাই সমূদ্রে হারিয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। এ বিষয়গুলো না জানলে ভ্রমণ খুবই বিপদজনক। তাছাড়া দু-একটি জায়গা আছে, যেখানে পা দেওয়া মোটেও উচিৎ নয়। যেমন উত্তরমুখের ডান কোণা। চোরাবালিতে পড়ে উধাও হয়ে যাবার ভয় আছে।
প্রথমেই আমরা সর্ব দক্ষিণে ছেঁড়া দ্বীপ ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেইমতো রিকশা ভ্যান রিজার্ভ করে চেপে বসলাম। বাংলাবস নামে পাকা রাস্তা ধরে প্রায় ৮ কিলোমিটারে গিয়ে বিপদজনক ছেঁড়া দ্বীপ। ভাটা থাকতে থাকতেই আমরা বেশ দ্রুততার সঙ্গে ভ্রমণের কাজ সারতে চাইলাম। প্রথমেই দারুচিনি দ্বীপ। যথেষ্ট নারকেল বাগান রয়েছে। তবে অপেক্ষা করার সময় ছিল না। দুপুরের পরপরই জাহাজে ফিরতে হবে। তাই আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। ছেঁড়া দ্বীপ এবং নিঝুম দ্বীপে কিছু সময় কাটিয়ে চলে এলাম সেন্ট মার্টিনের মাঝামাঝি অবস্থানে। এখানে মিউজিক ইকো রিসোর্ট, কোরাল ব্লু, কোকোনাট কোরাল ঘোরার সময় দুপুরের খাবারও খেয়ে নিলাম। খাবার বলতে প্রধান আকর্ষণ সামুদ্রিক মাছ। নানা পদের নানা সাইজের। ফুটপাত রেস্তোরার মতো দোকান তো রয়েছেই, ভাল মানের হোটেলও আছে। আমরা এই মাছ ইচ্ছেমত খেয়ে নিলাম। রিকশাভ্যান চালককেও পেটপুরে খাওয়ানো হলো। খুঁশীতে বাগবাগ হয়ে উঠলো ভ্যান চালক মতি। এরপর আমরা ডাব খেতে খেতে বাংলাবস সড়ক ধরে আবার ফিরতি পথে চললাম। তবে এরই ফাঁকে ফাঁকে নারিকেল জিঞ্জিরা, প্রবাল সৈকত, কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের সমুদ্র বিলাস ভবন হয়ে অনেকটা এলাকা ঘুরে ফেললাম। নানাজনের সঙ্গে কথা বলে দ্বীপ সম্পর্কে মজার মজার তথ্য জানলাম।
এই দ্বীপটা নাকি আস্তে আস্তে সাগর থেকে জেগে উঠেছে। অবশ্য তা বছরের পর বছর বা যুগের পর যুগ ধরে। প্রথমে অল্প জায়গা উঠে দাঁড়ায়। তাতে গাছপালা জন্মায়। তারপর দ্বীপের আকার বাড়তে থাকে। গাছপালা বনভূমিও বাড়তে থাকে। এরকম এক পর্যায়ে জায়গাটি জাহাজগামী মানুষের নজরে আসে। সেই থেকে মানব বসতি বাড়তে থাকে। দ্বীপও জেগে জেগে বড় হচ্ছে, মানব বসতিও বাড়ছে। এখন তো রীতিমতো দালান-কোঠা, ঘর-বাড়ি-অফিস-প্রতিষ্ঠান-স্কুল-মাদ্রাসা গড়ে উঠে একটা আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন অত্যাধুনিক আবাসিক হোটেল পর্যন্ত হয়ে গেছে। তবে সামুদ্রিক জোয়ার-ভাটার সাংঘাতিক প্রভাব আছে। আছে ঝড়-বাতাসের ভয়ঙ্কর আক্রমন। খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বেশিরভাগ স্থানীয় বাড়ি-ঘরের ছাদ প্রায় মাটি সমান করে বানানো। এতেকরে ঝরের সময় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচা যায়। মাথার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু ঘর-বাড়ির তেমন ক্ষতি হয় না। আর জোয়ার-ভাটার সময় কখনও ভূখন্ড খা খা বালির উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আবার কখনও মুহূর্তেই সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যায় নিচু এলাকা।
বেশ কয়েকজন কোন এক ভূমিকম্পের সময়ের কথা বলছিলেন। তখন নাকি যারা সমুদ্রে মাছ ধরছিল, তারা দেখেন- হঠাৎ করে সমুদ্র উধাও হয়ে গেল। অর্থাৎ সমুদ্রের পানি নাই হয়ে গেল। তখন বিশাল বিশাল সাদা মাছ, হাঙ্গর, কুমির বালির উপর দাপাদাপি করতে থাকে। পানি চলে যাওয়ায় ওগুলো শুকনো বালিতে পড়ে গিয়েছিল। জেলেরা জাল ছেড়ে বড় বড় মাছগুলো পাকড়াও করতে ছুটে যান। তারপর মুহূর্তেই দেখতে পান আকাশ সমান উঁচু সমুদ্র ধেয়ে আসছে। ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে তারা মাছ ফেলে তীরের দিকে ছুটতে থাকেন। কিন্তু সাগরের কাছে হার মানেন। সাগর এসে গ্রাস করে এইসব জেলেসহ বাড়িঘর সবকিছু। জেলেদের কেও কেও কোন রকমে বিশাল বিশাল পাথর আঁকড়ে ধরে প্রাণ বাঁচান। যারা তা পারেননি তারা সাগরে হারিয়ে যান। তাদের আর ফেরত পাওয়া যায়নি। যারা পাথর আঁকড়ে কোন রকমে বেঁচেছিলেন, তারা পরে এসব গল্প করেন। সাগরের পানি অবশ্য বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। কয়েক দফায় আসা যাওয়া করে ভূমিকম্প শেষ হতেই আগের জায়গায় চলে যায়।
এমনিতে এখানকার বাসিন্দাদের বেশিরভাগই সামুদ্রিক মাছ ব্যবসায়ী। অনেকে মাছ ধরে রফতানি করেন, আবার অনেকে হোটেল বা দোকান দিয়ে ব্যবসা করেন। সেন্টমার্টিনে প্রবেশ পথ থেকে ভেতরের সব স্পটেই শুটকি মাছের দোকান রয়েছে। মোটামুটি সস্তা দামেই এ মাছ কেনা যায়। আর হোটেল-মোটেলগুলোতে মাছ ফ্রাই করে বিক্রি হয়। দাম তেমন বেশি নয়। এইসব ব্যবসার বাইরে এখানকার তরুণ-যুবকরা পর্যটন শিল্পের নানা কাজে ব্যস্ত। গাইড থেকে শুরু করে হোটেল কর্মচারি, পর্যটকদের বয়ে বেড়ানো রিকশা চালানো, ছবি তুলে দেওয়া, ফাই-ফরমাশ খাটা থেকে নানা কাজ করে এরা আয় করেন। এছাড়া কৃষিকাজ এবং জাহাজ-বোট-নৌকা চালিয়ে বা এগুলোতে কাজ করেও জীবিকা নির্বাহ করেন। হাঁস-মুরগী-গরু-ছাগল সবকিছুই আছে এখানে। ফল-মূলের গাছ কম নেই। এখানে চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচনও হয়। আছে গ্রাম্য বিচার ব্যবস্থা। যা নিয়ন্ত্রণ করেন চেয়ারম্যান ও তার সহযোগী মেম্বাররা। অবশ্য থানা-পুলিশ এবং কোস্ট গার্ড ও সামরিক বিশেষ বাহিনীর লোকেরাও আছে নিরাপত্তার দায়িত্বে।
সেন্ট মার্টিনে মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা আছে জেনারেটরের মাধ্যমে। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন টেলিভিশন ছিল না। এখন সব আছে। আগেই বলেছি, এখানে তারকা মানের হোটেল পর্যন্ত আছে। সব আছে বলেই জমজমাট পর্যটন ব্যবসা। যখন এর কিছুই ছিল না তখনই কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ এখানে এসে জায়গা কিনে দ্বিতল কাঠের বাড়ি পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছিলেন। ‘সমুদ্র বিলাস’ নামের বাঁশ-কাঠ-ইটের বাড়িটি এখনও তাঁর স্মৃতিকে ধরে রেখেছে।
যদি এক কথায় বলা হয়, তাহলে সবমিলিয়ে অপূর্ব জায়গা এই সেন্টমার্টিন। চারদিকে সমুদ্র। তার ভেতর মাথা উঁচু করে আছে ছোট্ট ভূখন্ড। ভূখন্ডের তটভূমি জুড়ে প্রবাল। তবে প্রবাল দ্বীপ বলে যে জায়গাটি, সেখানে প্রবাল দেখার মতো। বিরাট বিরাট প্রবালের সমাহার ছড়িয়ে সেখানে। আর সে প্রবাল মোটেও মৃত নয়। রীতিমতো জীবিত। রাতের বেলা ওই প্রবালে শুয়ে-বসে থাকলে এটা টের পাওয়া যায়।
সেন্টমার্টিন নৈসর্গের রূপ নেয় রাতে। যদিও আমাদের রাত উপভোগ করার সুযোগ হয়নি। কারণ দুপুরের পরপরই ফিরতে হয়েছিল। যাঁরা রাত দেখেছেন তাঁদের কাছে শোনা- তটের বালুভুমিতে শুয়ে গোটা রাত কাটিয়ে দেওয়া যায়। অবারিত আকাশের তারকারাজির নিচে ঠাঁয় মরার মত পড়ে থেকে উপভোগ করা যায় ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক গর্জন, ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। মায়াবি বাতাসের অদ্ভুৎ শো-শা শব্দও সাংঘাতিকভাবে আলোড়িত করার মত। এক কথায় বালুর চাদরে শুয়ে ভিন্ন এক জগতে বাস করা যায়, নিজেকে উজার করে দেওয়া যায় প্রকৃতির কাছে। সে কারণে এই বালুচরে অগণিত তরুণ-তরুণি শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেন। আবার প্রায়ই বিভিন্ন কনসার্ট দল এসে ছাউনি টাঙ্গিয়ে রীতিমত গানের আসর বসিয়ে চারদিক মাত করে রাখে। এইসব উপভোগ করতে হলে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করতেই হবে। সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে এসব।
নিজের কাছে মনে হয়েছে কয়েকটি কারণে সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করা জরুরি। যেমন এই দ্বীপ ঘুরে জানা যাবে- কত অসম্ভবই না সম্ভব হতে পারে। কেমন করে গভীর সমুদ্রে ভ‚মির জন্ম হয়, কেমন করে জীববৈচিত্রের সৃষ্টি হয়, কেমন করেই’বা মানুষর জন্য প্রকৃতি তৈরি হয়। এসব জানতে এখানে না এলে চলবে না। বিশেষ করে কেউ যদি স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করতে চান- তাহলে তাকে রাত কাটানোর জন্য সেন্টমার্টিনে আসতেই হবে। অর্থাৎ বিচিত্র দৃশ্য, বিচিত্র জীবন-যাপন, সমাজ, রীতি-নীতি, বৈচিত্র খুঁজতে চাইলে এবং জীবনকে জীবনের মতকরে উপভোগ করতে চাইলে কোন দ্বিধা না করে ছুটে আসতে হবে এই প্রবাল দ্বীপে।
যাতায়াত ব্যবস্থা :
রাজধানী ঢাকা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বাসে এসে, জাহাজ বা ট্রলারে করে যেতে হবে সেন্টমার্টিনে। ফিরতেও হবে সেভাবে। ঢাকা থেকে টেকনাফ বাসভাড়া (এসি ছাড়া) জনপ্রতি ৯শ টাকা থেকে ১৭শ টাকার মধ্যে। টেকনাফ পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘন্টা। বাস সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে শ্যামলী, হানিফ, গ্রীন লাইন, ইউনিক পরিবহন ইত্যাদি। আবার সরাসরি ঢাকা থেকে টেকনাফে না এসে কক্সবাজারেও রাত কাটানো যায়। তারপর ভোর বেলা টেকনাফের পথে রওনা হওয়া যায়। কক্সবাজারে রাত কাটাতে সাধারণ হোটেলের রূম ভাড়া দেড় হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। এমন হোটলের মধ্যে রয়েছে ব্লু-মারিন, কল্লোল, সি ক্রাউন, সুগন্ধা রেস্ট হাউজ, হানিমুন রিসোর্ট, কোরাল রীফ, ড্রিম নাইট, লাববা বিলাস, প্রসাদ প্যারাডাইস, নীল দিগন্ত ইত্যাদি। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে বাসভাড়া জনপ্রতি দেড়শ টাকার মতো। সেন্টমার্টিন যেতে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাটে পৌছাতে হয়। ৯টার মধ্যে জাহাজ ছেড়ে দেয়। প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা লাগে সেন্টমার্টিন পৌছাতে। জাহাজ ভাড়া আপ-ডাউন ৬/৭শ টাকা। এছাড়া ট্রলার ভাড়া করেও যাওয়া যায়। তাতে জনপ্রতি ভাড়া একশ টাকার মতো। রিজার্ভ ৬/৭শ টাকা। সেন্টমার্টিন থেকে আবার দুপুর আড়াইটার দিকে জাহাজে উঠে ফিরতে হয়। জাহজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কেয়ারি সিন্দাবাদ, কতুবদিয়া, গ্রিনলাইন। সেন্টমার্টিনে রাত কাটানোর জন্য সাধারণ হোটেলের রূম ভাড়া ১২শ টাকা থেকে ১৭শ টাকার মধ্যে।