দার্জিলিং ভ্রমণ (পর্ব : দশ)
ইয়াসমিন হোসেন
রাস্তায় অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে এবার রওনা হলাম পরের জায়গায়। মনি বলছিলেন, তিনি এমন একটি জায়গায় নিয়ে যাবেনÑ যেখানে বৈচিত্রময় নানা দৃশ্য দেখা যাবে। তিনি নিয়ে যাবেন Gorkhaland Territorial Administration (GTA)-এর এলাকায়।
সেইমতো তিনি ঘণ্টাখানেক ধরে বিশাল পাহাড়ি এলাকা ঘোরাতে ঘোরাতে আঁকা-বাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চললেন। লক্ষ্য করলাম, পাহাড়ের গা বেয়ে গাড়ি ক্রমেই নিচের দিকে নামছে।
প্রথমে বুঝতে না
পারলেও পরে বুঝেছিলাম আমার দু’কান বন্ধ হয়ে আসছিল। শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না। কানে পানি ঢুকলে যেরকম ধাপা ধরার মতো লাগে সেরকম লাগছিল। আর ক্রমেই ঠান্ডা কম
মনে হচ্ছিল। আসলে আমরা পাহাড় বেয়ে চলছিলাম একেবারে নিচে, অর্থাৎ দার্জিলিংয়ে আমরা যতো উঁচুতে অবস্থান করছিলামÑ তা থেকে একেবারে নিচের সমতল ভূ-পৃষ্ঠের দিকে যাচ্ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই স্পর্শকাতর নার্ভ হিসেবে কানের ভেতর বায়ুমন্ডলের চাপ বাড়ছিল। এতে কানের নরম পর্দাগুলো ভেতরের দিকে সেঁটে গিয়ে কান বন্ধ করে দিয়েছিল।
এই ঘটনাটা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম
তখনÑ যখন কিনা একেবারে নিচে নেমে গাড়ি দাঁড় করানো হলো।
দাঁড় করানোর মিনিট ৫/৭ পরে হঠাৎ করেই দেখলাম কানের ধাপা
ধরা ছুটে গেল।
চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমরা পাহাড়ে ঢাকা পড়ে আছি। আকাশ রবাবর চলে গেছে পাহাড়ের মাথা। আমরা যেন উপর থেকে কোন এক তলানিতে পড়ে গেছি। মনি আরও নিচের দিকে দেখিয়ে টিকেট কেটে বেড়ানোর জন্য বললো। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন রাস্তার উপর। আমরা ছাড়াও আরও কতগুলো পর্যটকের গাড়িবহর এই
স্থানে দাঁড়িয়েছিল। মনির দেখানো জায়গায় বেশকিছু ভবন চোখে পড়লো। নির্মাণ কাজের ট্রাকসহ যন্ত্রপাতিও দেখা গেল।
আমরা ১০ রুপি করে টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম।
টিকেটে লেখা আছে- GORKHALAND,
TERRITORIAL ADMINISTRATION, DEPERTMENT OF TOURISM, CHUNNU SUMMER FALLS, Tourist
Spot।
লক্ষ্য করলাম, গোটা এলাকাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করতে মহাকান্ডকারখানা করা হয়েছে।
পাহাড়ের নানা জায়গায় রয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণা, লেক, আমাদের দেশে কৃত্তিম বেড়ানোর জায়গার মতো রাস্তা-ঘাট, বসার জায়গা, নানান ধরনের মূর্তি-প্রতিকৃতি, পাথরের কারুকাজ করা স্থাপনা, পাহাড়ি গাছপালার ভেতর দিয়ে... গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ...
এর মতো পথ। এসব জায়গায় পা দিতেই কী
যে অসাধারণ অনুভূতি হচ্ছিলÑ ভাষায়
প্রকাশ করার মতো নয়। যদিও খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা, আবার নেমে আসা, আবার উঠা, আঁকাবাঁকা পথে ঘুরপাক খাওয়া পথ কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জুড়ে থাকায় আমাদের শারীরিক সাধ্যে অতকিছু সায় দিচ্ছিল না। আমরা যতো সংক্ষিপ্ত আকারে সম্ভব ঘুরে ঘুরে সবকছু দেখে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম। এখানেও ভিড় ছিল কলকাতাসহ পশ্চিমা এবং ইউরোপীয় দেশের লোকজনে।
সবাই এসেছেন নৈসর্গিক এবং জীববৈচিত্রের সমাহার স্বচক্ষে দেখতে। আমাদের সঙ্গে কলকাতা থেকে আসা একটি পরিবার ছবি উঠালেন। তারা আমাদের ছবি তুললেন, আমরা তাদের ছবি তুলে দিলাম।
প্রায় দু’ঘণ্টামত ঘোরাফেরার পর আমরা দু’জনেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এখানে শীত ছিল না বটেÑ তারপরেও শরীর সায় দিচ্ছিল না। আসলে এসব জায়গায় এতো অল্প সময়ের জন্য এসে লাভ নেই। বসতবাড়ি-ঘর থাকলে অবস্থান করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে দেখতে পারলে সাধ মেটানো সম্ভব। কিন্তু সেটা তো
নেই। তাছাড়া আমাদের খুব দ্রæত
শেষ করতে হবে বেড়ানো। এরইমধ্যে সোয়া ১
টা মতো বেজে গেছে।
শরীর এতোই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যেÑ নিচে থেকে খানিকটা উপরে দাঁড়ানো আমাদের গাড়ির কাছে যেতেই কষ্ট হচ্ছিল। কোন রকমে উঁচু বন্ধুর পথ পার হয়ে গাড়ির কাছে এলাম। রওনা হলাম নতুন গন্তব্যে। মনি বেশ অনেকগুলো জায়গার নাম বলছিল। তার কথায়Ñ এগুলো না দেখলে বেড়ানোর মানেই হবে না। কিন্তু আমাদের তখন পিছু হটার অবস্থা।
ক্লান্তি এমনভাবে গ্রাস করেছিল যেÑ মনেই হচ্ছিল না
আর কোথাও যাই।
মনে হচ্ছিল হোটেলে চলে গিয়ে বিশ্রাম নিলে ভাল হতো।
কিন্তু মনির পীড়াপীড়িতে মাত্র একটা জায়গা দেখার ব্যাপারে রাজী হলাম। ----------- চলবে ----------