রবিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

গল্প : ধারাবাহিক [পর্ব- চার] শেকড়ের ডানা

 

শেকড়ের ডানা

ইয়াসমিন হোসেন

দেশে আন্দোলন এসে গেল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর সত্তরের নির্বাচন টগবগ করে ফুটতে থাকা সময় আহেদ আলীরা যখন পাকিস্তান রক্ষা নিয়ে শলাপরামর্শে ব্যস্ত, রাহুল তখন ব্যস্ত রাজপথের বিশাল বিশাল মিছিল নিয়ে স্কুল বন্ধ করে ছেলেরা মিছিলে যাচ্ছিল রাহুলও সেইসব মিছিলের সৈনিক চিকন গলা ফাঁটিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ওর রক্তের ভেতর অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলছিল বাবা বা পরিবার-পরিজনের ভয় উধাও হয়ে গিয়েছিল শরীরের ভেতর জন্ম নিচ্ছিল অন্য রকম এক শক্তি বাবার ধমক, হুমকি কোন কিছুকেই পরোয়া হচ্ছিল না

এই আগুন সময় যখন তুঙ্গে, তখনই পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি জাতির উপর কামান-মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আহেদ আলীরা তখন আনন্দে আটখানা হয়ে উল্লম্ফন করতে লাগলো রাহুলকে শক্ত কানমলা আর মুখ খিস্তি সহ্য করতে হলো কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা যখন কাওকে বাছ-বিচার না করে শেষ করে দেওয়া শুরু করলো, তখন আহেদ আলীদের মুখ শুকিয়ে গেল এরজন্য খানিকটা হলেও রাহুল মজা পেল

একাত্তরের মার্চের শেষ সপ্তাহ রাহুলের বয়স তখন আট রাতের বেলা হঠাৎ শুরু হলো মেশিনগানের গুলি টানা ঠা ঠা শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে গেল কিন্তু গুলি থামলো না থেমে থেমে একটানা চলতে লাগলো সারা রাত ভয়ে-আতঙ্কে তখন আহেদ আলী সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালানোর প্রস্তুতি নিলো পাশের রহমানও তার পরিবারের লোকজন নিয়ে তৈরি ছিল ভোররাতে বাড়ি-ঘর তালাবন্ধ করে সবাই একসঙ্গে গ্রামের পথে দৌড়ানো শুরু করলো মাথার উপর দিয়ে ছুটে যেতে লাগলো ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি পথে দেখা গেল হাজার হাজার পরিবার ওদের মতো পড়িমরি করে ছুটছে

আকাশ যখন পরিস্কার হচ্ছে তখন রাহুলরা পৌছালো মাইল দূরের এক গ্রামে সেখানে পরিচিত এক বাড়িতে গিয়ে সবাই হাজির হলো বাড়ির মালিক তিনটা পরিবারের একগাদা মানুষকে আশ্রয় দিলেন তার দুটো ঘরের একটায় সবাই মিলে ঘরটাকে গুছিয়ে নেওয়া হলো

প্রথম দিন গাদাগাদি করে একসঙ্গে থাকলেও পরেরদিন রহমান পাশের এক বাড়িতে তার দুই পরিবারের লোকজন নিয়ে উঠে পড়লো ফলে পুরো ঘরটি আহেদের হয়ে গেল এদিকে বাড়ির মালিক দূরের গ্রামের বাড়িতে গেলেন কোন কাজে তখন পুরো বাড়িটাই আহেদের জিম্মায় থাকলো অবশ্য যে ঘরে বাড়ির মালিক থাকতেন, সে ঘরটি তালা লাগিয়ে গিয়েছিলেন

এরমধ্যে গভীর রাতে আরও এক পরিবার শহর থেকে পালিয়ে এসে এই গ্রামে অসুস্থ অবস্থায় থেমে পড়লো কিছুতেই চলতে পারছিল না কয়েকটা ছেলে-মেয়ে আর স্বামী-স্ত্রী মিলে খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিল পরিবারটি অন্তত রাতের জন্য তাদের আশ্রয় দরকার কিন্তু তাদের কোন পরিচিত কেও এলাকায় ছিল না তখন গ্রামের কয়েকজন আহেদকে এসে ধরলো যে, রাতের মতো পরিবারটিকে থাকতে দেওয়া হোক আহেদ কিছুতেই রাজী হলো না সে কোন ঝামেলা নিতে চায় না বাধ্য হয়ে লোকজন পরিবারটিকে অন্য জায়গায় রাখার জন্য নিয়ে গেল ঘটনায় রাহুল খুব কষ্ট পেল, কিন্তু করার কিছু ছিল না

এভাবে কেটে গেল এক সপ্তাহ গ্রামের লোকজনকে আহেদ আলীসহ তার চিন্তার অনুসারীরা প্রচার করলো, পাকিস্তান হলো ইসলামের দেশ, আল্লাহর দেশ সেই দেশের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে শেখ মুজিব বড় অন্যায় করেছে এর পরিণাম ভাল হতে পারে না মসজিদে নামাজ পড়ানোর সময়ও এইসব প্রচার করা হলো

এদিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাদের খতম করে বাঙালিরা শহর দখল করেছে প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান মাঝে মাঝেই হানা দিয়ে বোমা ফেলছে, অথবা মেশিনগানের গুলি চালিয়ে ফিরে যাচ্ছে পাশাপাশি প্রতিদিনই শত শত মানুষ শহরের বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামের পথে পালাচ্ছে সপ্তাহের শেষ দিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো শহর দখল করতে ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা বিরাট বহর নিয়ে অভিযান শুরু করলো আকাশে জঙ্গি বিমানের বোমা বর্ষণ বেড়ে গেলে তখন আহেদরা ফের এই এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো

সকাল পরিস্থিতি খুব খারাপ রহমান আগেই গরুর গাড়ি ভাড়া করে রেখেছিল আহেদ আলী তারজন্যও একটা রাখতে বলেছিল রহমান সেইমতো তিন পরিবারের জন্য চারটি গরুর গাড়ি আনিয়েছিল মালপত্র তেমন কিছু ছিল না যা ছিল তা একটা গাড়িতে তোলা হলো বাকিগুলোতে সবাই গাদাগাদি করে যাবার ব্যবস্থা হলো

তখন শহরের দিকে পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোঁড়া শেল ছুটে আসছিল ঘন ঘন বিকট শব্দে কেঁপে উঠছিল সবদিক মাঝে মাঝেই হানা দিচ্ছিলো জঙ্গী বিমান সেগুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল সব দেখেশুনে আহেদ-রহমানসহ অন্যদের সরে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না

সকাল ৮টা নাগাদ গরুর গাড়ি চলতে শুরু করলো দূরের গ্রামের দিকে পথে এরকম আরও গরুর গাড়ি যোগ হলো সবগুলোতে বাচ্চা-কাচ্চা মিলিয়ে ঠাঁসা মানুষ পায়ে হেঁটেও চলছিল সারি সারি গ্রামের মানুষেরা এইসব পলায়নপর মানুষদের পানিসহ খাবার-দাবার দিচ্ছিলো অসুস্থ হয়ে পড়াদের সেবা করছিল

টানা বিকেল পর্যন্ত চলার পর গাড়ি থেমে পড়লো এক গ্রামে সেখানে রহমান আহেদের পরিচিত কেউ ছিল প্রথমে তাদের এক বাড়িতে সবাই উঠলো পরের দিন আহেদ আলী তার দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে উঠে পড়লো প্রথম দিন ওই পরিবারের সঙ্গে একই ঘরে থাকতে হয়েছিল পরদিন ছোটমত একটা ঘরে আহেদদের জায়গা হলো

এই বাড়িতে প্রায় মাসখানেক থাকতে হয়েছিল তার অনেক আগেই রহমানরা চলে গিয়েছিল তাদের গ্রামের বাড়ির পথে আহেদও পরিবারকে পাঠিয়ে দিলো শ্বশুর বাড়ি আর নিজে থাকলো এই বাড়িতেই সঙ্গে রাখলো রাহুলকে

এখান থেকে শহরের খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছিল এরমধ্যে পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে গেছে শহর কিছুদিন পর তারা অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার নির্দেশ জারি করলো আহেদ আলী সেইমত এখান থেকেই মাদ্রাসায় যাওয়া-আসা করলো তারপর আস্তে আস্তে রাহুলকে নিয়ে শহরের বাড়িতে উঠে পড়লো এর কিছুদিনের মধ্যেই বৈঠকখানার সেই মওলানা সাহেবও এলেন তিনিও থাকবেন এবং চাকরিতে যোগ দেবেন ফলে তিনজন মিলে থাকা শুরু হলো খাওয়া-দাওয়ার জন্য আহেদের রান্নার কাজ করলো রাহুল, আর মওলানা সাহেব নিজের রান্না নিজেরমত করে করতে লাগলেন

সময় গড়াতে লাগলো মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মধ্যেই আচমকা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বেসামাল করে তুলতে লাগলো ধরপাকড় এবং হত্যাযজ্ঞ বেড়েই চলছিল রাজাকার-আলবদর আর জামায়াত-মুসলিম লীগারদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঙালিদের বিরুদ্ধে আর আহেদ আলী মাদ্রাসায় গিয়ে দালালদের সায় মেলাচ্ছিল মাদ্রাসাটি ছিল রাজাকার-আলবদর এবং জামায়াত-মুসলিম লীগারদের ঘাঁটি সেখানকার এক মওলানা পাকিস্তানিদের পুরস্কার স্বরূপ প্রতিমন্ত্রীত্বও পেয়েছিল

আহেদ আলী দালালদের সঙ্গে দালালী করলেও রাহুল হাঁটছিল উল্টো পথে নিয়মিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালিয়ে খবরাখবর রাখছিল শিশু হবার কারণে বেশ কিছু সুবিধাও পাচ্ছিল ওকে কেও মানুষ বলে গণ্য করছিল না, অথবা কোন সন্দেহের কথা ভাবছিল না এই সুযোগে নানান জায়গায় অবাধে ঘোরাঘুরি করে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার, আলবদর, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং নকশাল বাহিনীর অবস্থাগুলো জেনে রাখছিল সুযোগ পেলেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাজিয়ে গ্রামের লোকজনকে সাহসী করে তুলছিল নিজেও দুঃসাহসিক হয়ে উঠেছিল আহেদকে মোটেও ভয় করছিল না আর কারণ চারদিক থেকে শুধু মুক্তিবাহিনীর জয়ের খবর আসছিল

 

-------- চলবে ----------

শ্রীলংঙ্কা ভ্রমণ-১ [ Travel to Sri Lanka-1]

   শ্রীলংঙ্কা ভ্রমণ-১ [ Travel to Sri Lanka-1] শ্রীলংঙ্কা ভ্রমণ-১ [ Travel to Sri Lanka-1] : দক্ষিণ এশিয়ায় আলোচিত দেশগুলোর একটি শ্রীলংঙ্কা।...