শেকড়ের ডানা
ইয়াসমিন হোসেন
আহেদ যখন ভাবতে ভাবতে দিশেহারা, তখনই বিধাতা মুখ তুলে তাকালো। শুধু মুখ তুলে তাকানোই নয়, একেবারে আঙ্গুল ফুরে কলাগাছ বানিয়ে দিলো।
রাহুলের কাছে পার্টির একটা ফান্ড জমা রাখা ছিল। টাকার অংকে দুই লাখ। সবার বিরুদ্ধে হুলিয়া থাকায় রাহুলকেই পার্টি সবচেয়ে নিরাপদ রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু রাহুল এগুলো লুকিয়ে রাখার উপযুক্ত জায়গা তখনও খুঁজে পায়নি। বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে বড় একজোড়া গাম বুটের ভেতর রেখে দিয়েছিল।
এ সময়ই একটা অপারেশনের দায়িত্ব পড়েছিল রাহুলের উপর। অপারেশনটা ছিল- সন্ধ্যারাতের দিকে গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে গোটা শহরে প্রচারপত্র বিলি করতে হবে। এটা করতে গিয়েই গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় রাহুলসহ ওর এক সঙ্গী। এরপর ওকে পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা অফিসার বিষযটি সামরিক বাহিনীকে জানায়। সামরিক অফিস ওদের দুজনকে কালবিলম্ব না করে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
ধরা পড়ে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিল রাহুল। নির্যাতন ভোগ করায় ওর যতোটা না ভয় ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি দুঃচিন্তা ছিল ঘরে রাখা পার্টির ফান্ড নিয়ে। কারণ ওটা ছাড়া পার্টির চলা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। নিঃসন্দেহে সেনারা ওর ঘর তল্লাসি করবেই। তখন ওটা বেরিয়ে পড়ার দুঃচিন্তায় ভুগছিল ও। আবার একটা আশাও ছিল ওর। এই ফান্ড কোথায় রাখা আছে- সেটা পার্টি কমান্ডকে জানানো ছিল। ও ধরা পড়েছে- এটা জানলেই কেবল পার্টি কমান্ড যে কোন প্রকারেই হোক, এটি উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। রাহুল ভাবছিল, এরজন্য তো সময়মত পার্টি কমান্ডকে জানতে হবে যে ওরা ধরা পড়ে গেছে। এটা জানতে যদি বিলম্ব হয় তাহলেই বিপদ।
রাহুল ভাবলো, সামরিক বাহিনীকে ওর বাড়ি-ঘরের ঠিকানা জানাতে যতোটা সম্ভব বিলম্ব করতে হবে। যে কৌশলেই হোক, যতো নির্যাতন বোগ করেই হোক- খুব তাড়াতাড়ি এটা বলা যাবে না। অন্তত রাতটা পার করতেই হবে। রাহুল এ প্রতিজ্ঞায় অটল থাকলো। সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতন সত্ত্বেও রাতে ও মুখ খুললো না, সকালেও না।
কিন্তু আরেক দিকে ঘটলো অন্য ঘটনা। রাহুলদের ধরা পড়ার খবরটা পার্টি সঙ্গে সঙ্গেই পেয়েছিল। কিন্তু তখন তাদের জন্য উদ্ধার অভিযানে নামার সুযোগ ছিল না। কারণ গোটা শহরে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল হাজার হাজার সেনা সদস্যকে। তারা গ্রুপ গ্রুপে ভাগ হয়ে এলাকায় এলাকায় চিরুনি তল্লাশিতে নেমেছিল। সে কারণে রাতে ফান্ড উদ্ধারের কোন সুযোগ ছিল না। তবে পার্টি সকাল বেলায় একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল।
পার্টির এক মহিলা কমরেডকে পাঠানো হয় রাহুলদের বাড়িতে। রাহুল ঘরে তালা লাগিয়ে গিয়েছিল। ওর বাড়ির কেউ তখনও জানে না যে, রাহুল ধরা পড়ে মিলিটারি ক্যাম্পে আছে। মহিলা কমরেড বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আহেদের সামনে পড়ে গেল। সে তখন প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেললো কমরেডকে। মহিলা কমরেড জানালো, রাহুল মিলিটারির হাতে ধরা পড়েছে। ওর কিছু জিনিসপত্র ঘরে আছে, সেটা রাখা নিরাপদ নয়। তাই ওগুলো নিয়ে যেতে এসেছি। ওগুলো না নিলে আপনিও বিপদে পড়বেন।
আহেদ তখন প্রশ্ন করেছিল, জিনিসপত্র কোথায় রাখা আছে? জবাবে মহিলা কমরেড সত্যি কথাই বলেছিল যে, ওগুলো চৌকির নিচে রাখা একজোড়া গামবুটের ভেতরে রাখা আছে।
এরপর তিনি তালা ভেঙে ঘরে ঢোকার কথা বলেন। আহেদ বাধা দিয়ে কমরেডকে হাত চেপে আটকে ফেলে। ভয় দেখায় এখনই পুলিশের হাতে তাকে তুলে দেবে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় ভয় পেয়ে যান কমরেড। তিনি তখন সর্বশক্তিতে ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়েই দৌড়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে মিলিটারি ক্যাম্পে রাহুলকে আর বাড়ির ঠিকানা বলতে হয়নি। সকাল ১০টার সময় ওর বাবা আহেদ নিজেই গিয়ে হাজির হয় ক্যাম্পে। গিয়েই রাহুলের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলে ধরে। জানায়, রাহুল অস্ত্রধারী গেরিলা। তাকে হত্যা করার জন্য অনেকবার চেষ্টা করেছে। সে আন্ডাগ্রাউন্ড পার্টির সঙ্গে যুক্ত। ওর কাছে অনেক অস্ত্র আছে। এসব ব্যাপারে পুলিশকে সে অনেকবার জানিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করেনি। আহেদ আরও জানায়, কোনভাবে রাহুল ছাড়া পেলে বা বেঁচে থাকলে বহুরকম অঘটন ঘটাবে। ও যেন কোনভাবেই ছাড়া না পায়।
পাক্কা অভিনেতার মত অভিনয় করে অসহায় ভাব নিয়ে সামরিক অফিসারের কাছে এসব বর্ণনা করে আহেদ। ফলে তার সব কথা বিশ্বাস করে অফিসার। তারপর রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে একদল সেনা বাড়ি তল্লাসি করতে যায়।
রাহুলকে যখন ওর ঘরের সামনে নেওয়া হয়, তখন দেখে তালা ভাঙা। আগেই কেউ ঘরে ঢুকেছিল। সেনারা ওকে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে কোথায় কী আছে দেখিয়ে দিতে বললো। রাহুল লক্ষ্য করে চৌকির নিচে বুটজোড়া নেই। অন্যসব কিছু ঠিক আছে। সেনারা তল্লাসি করে কিছু বইপত্র আর পার্টির প্রচারপত্র পেল। সেগুলো নিয়েই তারা অভিযান শেষ করলো।
রাহুল ভেতরে ভেতরে প্রশ্নবানে বিদ্ধ হচ্ছিল। বুটজোড়া ও দেখতে পেলে না কেন? সেনারাও কেন তল্লাশি করে পেল না? এই বুটের বিষয়ে তারা কোন প্রশ্নও কেন করলো না? তাহলে কি ওই বুট তারা পায় নি? না পেলে কে নিলো?
পুরো এক সপ্তাহ সামরিক ক্যাম্পে আটকে রেখে, কখনও ফায়ারিং স্কোয়াডে দাড় করিয়ে, কখনও পা বেধে ঝুলিয়ে রেখে নাকে-মুখে গরম পানি ঢেলে, কখনও জ্বলন্ত লৌহদন্ডের ছ্যাকা দিয়ে, কখনও হাতপা বেঁধে গরুপেটা করে, কখনও ব্লাকহোলে ঢুকিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি করা হলো রাহুলকে। কিন্তু তেমন কোন তথ্য এবং জিনিসপত্র আদায় করতে না পেরে সেনারা স্লোপয়জনিং করে রাহুলকে আধা মরা অবস্থায় থানা পুলিশের হাতে তুলে দিলো। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ওকে ওই অবস্থায় কোর্টে পাঠিয়ে দিলো। কোর্ট থেকে ওর স্থান হলো জেলখানার হাসপাতালে।
বিধাতা এভাবে মুখ তুলে তাকানোয় যারপর নাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো আহেদ। কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি এভাবে তার ভাগ্য ফিরবে। কেন ফিরবে- তা কেবল নিজেই জানে আহেদ। এ কথা কাউকে কোনদিন বলবে না সে। এখন আর যেহেতু কোন বাধা নেই, সেহেতু যা ইচ্ছা করতে পারবে সে। বিয়ে করতে পারবে ঘন ঘন। আনন্দে তার নাচতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
যদিও অল্পদিনেই বাধা পড়লো আনন্দে। রাহুলের দলের অন্তত জনাতিনেক শক্ত-সামর্থ্য লোক এক সন্ধ্যে রাতে আটকে ফেললো তাকে। বুকে চেপে ধরলো সাব মেশিনগান। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অ অ গঁ গঁ করে কোন রকমে প্রশ্ন করলো, কি হয়েছে স্যার? জবাবে ওরা বললো, ভাববেন না আপনার ছেলে জেলখানায় আছে বলে আপনার কোন ভয় নেই। আপনি যদি কোনদিন আরেকটি বিয়ে করেন, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের উপর অত্যাচার করেন, তাহলে আপনাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। ভুলেও যদি বিয়ের চিন্তা মাথায় আনেন, তাহলে মনে করবেন- আপনি শেষ, আপনার লাশ পড়ে থাকবে। মনে রাখবেন, রাহুল জেলে থাকলেও আমরা অনেকে বাইরে আছি। আর আমরা আপনার সব খবর রাখছি। কাজেই সাবধান। আমাদের বা আপনার ছেলে রাহুলের কানে যেন আর কোনদিন এই দুইটা অভিযোগ না আসে। আমরা এইটুকু বলতে এসেছিলাম। বলে গেলাম। সাবধান থাকবেন।
ওরা চলে গেছে। তারপরেও আহেদ আতঙ্কে অনেকক্ষণ নড়তে পারলো না। ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির ভেতর ঢুকলো।
প্রাণের ভয়ে আহেদ কথা রেখেছিল। আর বিয়ের পথে পা মারায়নি। স্ত্রী-সন্তানদেরও অত্যাচর করেনি। তবে চরিত্রের বাকিসব আগের মতই থাকলো। কারণ সাব মেশিনগানধারীরা এগুলো বদলাতে বলেনি। সুতরাং এগুলোতে বাধা নেই বলে ধরে নিল সে।
এদিকে রাহুল জেলে বসে শুধু একটা কথাই ভাবছিল, বুট জুতোর ভিতর রাখা পার্টির ফান্ড গেল কোথায়? পার্টির তরফ থেকেও এ প্রশ্ন করা হয়েছে। কে নিলো এটা? কিছুতেই ভেবে বের করতে পারলো না রাহুল। মিলিটারিরা নিয়েছে বলে যে ধরে নেবে, তাও পারছে না। কারণ বাড়িতে যাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে ও ছিল। ওরা নিলে টের পেতো। অথবা এই টাকার উৎস কোথায়- তা জানার জন্য টর্চার করতো ওরা। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। তাহলে ওটা উধাও হলো কীভাবে? ওই ঘরে তো আর কেউ যায়নি? তাহলে কি আহেদ আলী এই কাজটা করেছে? সে জানলো কিভাবে রাহুল ধরা পড়েছে? আবার কেনই-বা সে নিজে থেকে মিলিটারি ক্যাম্পে গেল? এই ধাধার উত্তর কিছুতেই মেলাতে পারছিল না রাহুল।
--- চলবে ---