শেকড়ের ডানা
- ইয়াসমিন হোসেন
চল্লিশ বছর পর। রাহুল পরিণত, প্রতিষ্ঠিত। সমাজে ওর একটা দাম তৈরি হয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে সরে আসে। তারপর ঢুকেছে কর্মজীবনে। অভাব-অনটন থাকলেও এ জীবন তাঁকে উন্নত স্তরে নিয়ে এসেছে। পরে সংসারও গড়েছে। বিয়ে করেছে এক শুভার্থী বোনের পছন্দমত। শর্ত ছিল যৌতুক এবং কোনরকম উপঢৌকন নেওয়া যাবে না। শর্তমতই সব হয়েছে। কারণ প্রতিবাদের জীবন থেকে এটাই শিক্ষা পেয়েছে। আর এ শিক্ষাই ওর আদর্শ।
রাহুল জানতো, আহেদ আলী ওর মৃত্যু অথবা ধ্বংস দেখতে চেয়েছিল। ধারণা করেছিল মিলিটারি-পুলিশের হাত থেকে প্রাণে বাঁচলেও রাজনীতির লোকের হাতেই ওর মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু যখন তার ধারণা সত্য হয়নি, তখন নিশ্চিত ছিল- পৌত্রিক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে কোনভাবেই টিকে থাকতে পারবে না। অভাব, অনটন আর আশ্রয়হীনতায় ধূকে ধূকে মারা যাবে। কিন্তু যখন এটাও হয়নি, তখন ভেবেছে- কোনভাবেই সুনাম কুড়াতে পারবে না। কিন্তু তাও যখন হয়নি, তখন ভেবেছে- সৎ পথে থাকতে পারবে না। কিন্তু রাহুল তাও থেকেছে। সব ক্ষেতেই আহেদের জন্য ফল উল্টোটা হয়েছে। তখন ভেবেছে, পৌত্রিক পরিচয়হীন রাহুল কোনদিন বিয়েও করতে পারবে না। কেও ওকে গ্রহণ করবে না, কেউ মেয়ে দেবে না। কিন্তু এখানেও পরাজয় ঘটেছে আহেদের। রাহুল সামাজিকভাবে সবার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং বিয়েও করেছে। রাহুল এসব ঘটনাগুলোকে নিজের বিজয় হিসেবে দেখেছে। লড়াকু জীবনের জয় বলে দেখেছে। আর আহেদের জন্য দেখেছে পরাজয় হিসেবে। এতেকরে এক ধরণের আত্মতৃপ্তি পেয়েছে ও। নিজেকে ধন্য মনে করেছে।
দীর্ঘ এতোগুলো বছরে রাহুলের সঙ্গে পৈত্রিক পরিবারের কোনরকম যোগাযোগ ঘটেনি। তারাও কোন খোঁজ করেনি। রাহুলই শুধু খোঁজ রেখেছে- আহেদ আলী শর্ত ভঙ্গ করেছে কিনা। জেনেছে, চরিত্র বদল না হলেও বিয়ে আর পরিবারের প্রতি অত্যাচারের পথে পা বাড়ায়নি সে। এতেই সন্তুষ্ট থেকেছে রাহুল।
রাহুল জানতে পেরেছে, ওর পিঠেপিঠি যে বোনটি ছিল- তাকে এক মুন্সির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর বোন গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু স্বামী ঝাঁড়-ফুক করা ছাড়া কোন চিকিৎসা করেনি। ফলে বিনা চিকিৎসায় বোনটি মারা যায়। পরের বোনটিকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক পুলিশের সঙ্গে। কিন্তু সেই পুলিশ যৌতুকের জন্য অত্যাচার-নির্যাতনের পর ওকে পরিত্যাগ করে। তারপর আহেদ আলী ওকে আরেকজনের সঙ্গে বিয়ে দেয়। এই ব্যক্তি আহেদের ২২ শতাংশ বসতি জমির চার শতাংশ নিজের পক্ষে লিখে নিয়ে বিয়ে করেছে। যৌতুকও নিয়েছে। তৃতীয় মেয়েটিকে আহেদ আলী বিয়ে দেয় গ্রাম্য একজনের সঙ্গে। আর চতুর্থ মেয়ে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে নিজের পছন্দের মামাত ভাইকে বিয়ে করে। আহেদের সৌভাগ্য, পালিয়ে বিয়ে করায় এই মেয়ের জন্য কোন যৌতুক দিতে হয়নি। তবে অন্যদের নানান কিছু দিতে হয়েছে। যা কিছু জমিয়েছিল, সব এভাবেই হারাতে হয়েছে।
রাহুলের আরও দুই ভাই আছে। এক ভাই ও থাকতেই জন্মেছিল। আরেক ভাই হয়েছে সবার শেষে। এই দুইয়ের মধ্যে বড়জন লিণ্টু, আর ছোটজন আণ্টু। এই দু’জনই মাঝে-মধ্যে রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। আহেদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে চিঠি লিখেছে। কিন্তু রাহুল তেমন একটা গরজ করেনি কখনও। তবে ওরা যখন জানিয়েছে, বাবা খেতে-পরতে দেয় না। মা খুব কষ্টে আছে। তখন আহেদ মায়ের জন্য প্রতিমাসে অল্প হলেও কিছু করে টাকা নিয়মিতভাবে পাঠাতে থাকে। এ টাকা লিণ্টুর ঠিকানায় পাঠায়। ওর হাত দিয়ে তা মায়ের কাছে পৌছার কথা। এছাড়া বিশেষ বিশেষ দিন যেমন ঈদে মায়ের জন্য কাপড়-চোপড় এবং চিকিৎসার জন্য খরচও পাঠাতে থাকে। কখনও কখনও দুই ভাইয়ের জন্যও টাকা ও জামা-কাপড় পাঠায়।
এদিকে রাহুল এ পর্যন্ত পুরনো রহস্যটির সমাধান পায়নি। সেই উধাও হওয়া পার্টির ফান্ড! একটা ক্ষেত্রে রাহুলের খটকা কেবলই বেড়েছে। ও জেনেছে, ওদের টিনের বাড়ি পাকা হয়েছে। মূল ঘরটি দোতলা করা হয়েছে। বিয়ের সময় মেযেদের এক থেকে দুই-চার লাখ করে টাকাও দেওয়া হয়েছে। আহেদ আলী শহরের বাইরে একটা বিরাট জায়গা নিয়ে জমি কিনেছে। পরে সেই জমি তার শিক্ষকতা করা মাদ্রাসাসহ আরেক মাদ্রাসাকে দান করেছে। এছাড়া ঢাকার গাজীপুরে তিন টুকরো জমি কিনেছে, যা এখনও পরিত্যক্ত। তিন জায়গায় জমির পরমিাণ তিন, দুই এবং দেড় শতাংশ। রাহুল ভেবে পায় না- এসব করার টাকা এলো কোথা থেকে? আহেদের তো চাকরি নেই। আবসরে চলে এসেছে। চাকরি বাবদ না-হয় তিন-চার লাখ টাকা পেয়েছে। কিন্তু এই টাকায় তো এতোসব কিছু করা যায় না। আয়ের আর কোনই পথ ছিল না। তাহলে এতো টাকা আহেদ পেল কোথা থেকে? রাহুলের পুরনো সন্দেহটা তাই বার বার পাকা হয়েছে।
----- চলবে -----