শেকড়ের ডানা
- ইয়াসমিন হোসেন
পাপ আর পূণ্যকে তেমন এটা গুরুত্ব দিতে রাজী নয় আহেদ আলী। তার কথা, পাপ হলো কেতাবের কথা। বাস্তবে ওইসব মানতে গেলে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। বাঁচতে হলে পাপ করতেই হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। সেই নিয়মই পালন করেছে সে। আর ধর্ম? এটা হলো একটা বর্ম বা ঢাল। এটা দিয়ে পাপকে ঢেকে রাখতে হয়, আর অন্যকে পদানত করতে হয়। যাদের জ্ঞান কম, বা যাদের জানাশোনা কম- তাদেরকে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখতে ধর্ম হলো উত্তম হাতিয়ার। ব্যবসা-আয়-রোজগারের জন্যও বড় হাতিয়ার। সেই হাতিয়ারই আহেদ আলীর শক্তি। এটা দিয়েই তাকে মাথা উঁচু রাখতে হচ্ছে। এ শক্তিকে পোক্ত করতে ধর্মের একটা লেবাস রাখতে হয়, হজ করতে হয়, নামাজ-রোজা করতে হয়। আহেদ আলী এসব করেছে বলেই না মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারছে। হোক পাপের টাকায় এতোসব- কিন্তু হাতে ধর্মের ঢাল থাকলে কার সাধ্য পাপী বলে? তা বলার সাহস কারও নেই। আহেদ আলীর বল ও শক্তি এটাই। পাপের টাকা মনে করলে স্ত্রীকে নিয়ে হজও করা হতো না, এতিমখানা-মাদ্রাসা-ধর্মপ্রতিষ্ঠানে দান করাও সম্ভব হতো না। না খেয়ে মরে ভুত হয়ে যেতে হতো। সুতরাং এসব নিয়ে কোনরকম ভয়-ভীতি-দুঃখ-কষ্ট নেই আহেদ আলীর।
তবে আহেদ আলী চিন্তিত বর্তমান নিয়ে। ব্যাংকে ভাল টাকা জমানো আছে ঠিক। কিন্তু নতুন আয় তো নেই। আয় না থাকলেও ব্যয় তো থামেনি। আয় ছাড়া চলতে গেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়, আমি তো কোন্ ছাড়! সুতরাং নতুন আয় চাই। নতুন কৌশল চাই, ফন্দি চাই। বড় ছেলেটা তো গেছেই, এখন ছোট দুইটাকে ‘মানুষ’ বানাতে না পারলে সব শেষ!
এ দুইটার মতিগতি অবশ্য খুব ভাল। যদিও মেজোটা একেবারেই কথাবার্তা শুনতে চায় না, কিন্তু ভিতরটা ঠিক নিজের মতই ‘মানুষ’। কেউ যদি এই ‘মানুষ’ বলতে ‘ইবলিস’ বোঝে, বুঝুক। তাতে আহেদ আলীর আসে যায় না। আহেদ আলীর ছেলে আহেদ আলীই হবে- এটাই শেষ কথা। বড়টা খসে গেছে, বাঁচা গেছে। তাই ছোট দুইটাই ভরসা।
একটা ফন্দি বা কৌশল বের করে ফেললো আহেদ। এটা সফল করতে পারলে হাতে নগদ কিছু টাকাও আসবে, আপদকেও ভাগানো যাবে। আহেদ জানে, মেজো মানে লিণ্টুর ভেতরে যৌবনের ডাক এসেছে। আর সে জন্য এদিক-সেদিক বেশ দৌড়াচ্ছে। মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক করে। মনে মনে হাসে আহেদ, একেই বলে ‘বাপ কা বেটা সিপাই কা ঘোড়া’। এই ঘোড়া এখন দৌড়াতে শুরু করেছে। প্রেম নিবেদন করতে স্বজন-নিকট আত্মীয় বলে কাউকে মানছে না। কানে এসেছে- নিজের বড় শ্যালকের মেয়ের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। পালিয়ে বিয়ে-টিয়ে করার মত চিন্তা-ভাবনাও চলছে। এইটাই সুবর্ণ সুযোগ। এমনিতেই কথা শোনে না, ডানে যেতে বললে যায় বায়ে, বায়ে যেতে বললে যায় ডানে। সুতরাং এইটাকে ফাঁদে আটকানো দরকার, আর সেই সুবাদে যদি কিছু হাতে নগদ লক্ষ্মী আসে- তাহলে আর চাই-কি! আহেদ লিণ্টুকে ডাকলো। বললো, তোর জন্য মেয়ে ঠিক করছি। বিয়ের জন্য তৈরি হ। লিণ্টু
হা/না কিছু না বলে চলে যায়। এদিকে আহেদ খোঁজ-খবর নিয়ে এক মুচির মেয়েকে পছন্দ করে ফেললো। কয়েক দফা দর কষাকষির পর ঠিক হলো, মুচি তার মেয়েকে লিণ্টুর সঙ্গে বিয়ে দেবে, আর যৌতুক হিসেবে নগদ দশ হাজার টাকা দেবে।
সব ঠিক। লিণ্টুও রাজী। তারপর এক রাতে আত্মীয়-স্বজন কাউকে না জানিয়ে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলা হলো। আহেদ কড়কড়ে ১০ হাজার টাকা হাতে পেলো। আর লিণ্টুও কিশোর বয়সী তরতাজা মেয়ে হাতে পেয়ে দারুণ খুঁশী। কিন্তু
দিন দুয়েক না যেতেই শুরু হয়ে গেল সংকট। আহেদের অভিযোগ, ছেলের বউ নামাজ-কালাম পড়ে না, শ্বশুর-শ্বাশুরিকে মান্য করে না। সংসার কাকে বলে তাও জানে না। আর লিণ্টুর অভিযোগ হলো, এই মেয়ে অযোগ্য। অন্য কারও সঙ্গে প্রেম আছে। যখন-তখন সেই প্রেমিক এসে ওকে তুলে নিয়ে যায়।
আরও কদিন যেতে না যেতেই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলো। লিণ্টু বউকে তালাক দিতে চায়। আর বউও ওরসঙ্গে থাকতে চায় না। শেষ পর্যন্ত অবস্থা আরও খারাপ হলো। বউকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেল লিণ্টু। শ্বশুর মামলা-মোকদ্দমার জন্য নেমে পড়লো। যৌতুকের নগদ ১০ হাজার টাকা ফেরত চাইলো। বিপদ বুঝে আহেদ আলী ঘোষণা দিয়ে দিলো, সে লিণ্টুকে ত্যাজ্য পুত্র করেছে। তার সঙ্গে আহেদের কোন সম্পর্ক নেই। যৌতুক সম্পর্কেও সে দায়ী নয়। এ টাকা লিণ্টুর কাছ থেকে নিতে হবে। এই নিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ দৌড়-ঝাপ চললো। লিণ্টু পালিয়ে রইলো। এক পর্যায়ে গরীব মুচি যখন বুঝতে পারলো, কোন ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না, মামলা-মোকদ্দমায় যাওয়া সাধ্যও তার নেই। তখন সে হাল ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে অন্য কোথাও বিয়ের জন্য চিন্তা করলো। আহেদ আলী ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে দারুণ তৃপ্তিতে হাত বুলাতে থাকলো দাড়িতে। লিণ্টুকে ভাগিয়ে রাখতে পেরেও স্বস্তি পেল। --------
চলবে ---------